ফুটবলকে বদলে দেওয়া পাঁচ কৌশল

কৌশলে নতুনত্বের মূল দায়িত্বটা কোচদেরই। ছবি: স্ট্রেইটসটাইমস
কৌশলে নতুনত্বের মূল দায়িত্বটা কোচদেরই। ছবি: স্ট্রেইটসটাইমস

শুরুর দিনগুলোতে খেলোয়াড়দের দক্ষতা কিংবা কসরতই ফুটবল ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাঠে কৌশলের গুরুত্ব বেড়েছে। দলীয় খেলায় দক্ষতানির্ভর কৌশল দেখিয়ে ম্যাচ ও সমর্থকদের মন জয় করেছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি কোচ মারিও জাগালো। ‘জোগো বনিতো’ বা ‘সুন্দর খেলা’য় মুগ্ধ করেছিলেন ’৮২-এর ব্রাজিলের কোচ তেলে, কিন্তু শিরোপা জিততে পারেননি। আবার মাঠের খেলায় বারবার কুৎসিত তকমা পেলেও কার্যকরী ফুটবল খেলে একের পর এক শিরোপা জিতেছেন হোসে মরিনহো। উদ্ভাবনী কৌশল বিশ্ব ফুটবলেরই চেহারা পাল্টে দেয়। দেখে নেওয়া যাক এ রকম পাঁচটি কৌশলগত পরিবর্তন।

মেসি-গার্দিওলা জুটি আবারও জনপ্রিয় করেন ফলস নাইনকে। ছবি: এএফপি
মেসি-গার্দিওলা জুটি আবারও জনপ্রিয় করেন ফলস নাইনকে। ছবি: এএফপি

ফলস নাইন:
লিওনেল মেসি-পেপ গার্দিওলা জুটির কারণে আধুনিক ফুটবলে বিখ্যাত হলেও ফলস নাইনের ধারণা বেশ পুরোনো। ত্রিশের দশকে অস্ট্রিয়া ফুটবল দলের অধিনায়ক ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার কিছুটা নিচে নেমে খেলতেন। এতে বিপক্ষ দলের ডিফেন্ডাররা জায়গা ছেড়ে ওপরে উঠে আসতে বাধ্য হতেন, আর ডি-বক্সে সহজেই জায়গা নিতেন ম্যাথিয়াসের সতীর্থরা। মূলত একই ফর্মুলায় কাজ করে ফলস নাইনও। ২০০৫-০৬-এর মাঝামাঝির দিকে রোমা কোচ লুসিয়ানো স্প্যালেত্তি আবারও ফলস নাইনের ব্যবহার দেখান। ২০০৯-এর সেই বিখ্যাত এল ক্ল্যাসিকোতে ২১ বছর বয়সী মেসিকে মধ্যমাঠে খেলান গার্দিওলা। তাঁকে আটকাতে বারবার জায়গা ছেড়ে আসতে হয় রিয়াল ডিফেন্ডারদের। আর পাশ থেকে ফরোয়ার্ড ইতো কিংবা উইঙ্গার ইনিয়েস্তা বারবার জায়গা খুঁজে পান রিয়ালের ডি-বক্সে। ৬-২ গোলে ম্যাচ জেতে বার্সেলোনা।

লিবেরো বা সুইপার পজিশনে ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় বেকেনবাওয়ার। ফাইল ছবি
লিবেরো বা সুইপার পজিশনে ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় বেকেনবাওয়ার। ফাইল ছবি

ক্যাতেনাচ্চিও:
শাব্দিক অর্থ দরজার শেকল বা খিল। ৫০-এর দশকে এই ইতালিয়ান কৌশল আবিষ্কৃত হয়, যেখানে রক্ষণে চার ডিফেন্ডার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফরোয়ার্ডদের ট্যাকল করতেন। পঞ্চম খেলোয়াড় ‘লিবেরো’ বা ‘সুইপারের’ কাজ ছিল রক্ষণ লাইনের পেছনে থেকে ট্যাকলের পর বল দখলে নিয়ে আক্রমণ শুরু করা। আর্জেন্টাইন কোচ হেলেনিও হেরেরো এই কৌশলের পথিকৃৎ। তাঁর ইন্টার মিলান দল এই কৌশলের সফল প্রয়োগে ৩টি স্কুডেট্টো ও দুটি ইউরোপিয়ান শিরোপা জিতে নেয়। ফুটবল-বিরোধী তকমা দেওয়া হলেও পরে অনেকেই এই কৌশলের আশ্রয়ে সফলতা পেয়েছেন। ফুলব্যাকদের আক্রমণে উঠে আসা ছিল এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য। যেখান থেকে উদ্ভব হয়েছে হালের উইং-ব্যাক বা অ্যাটাকিং ফুল-ব্যাক পজিশনের। ইতালিয়ান ফুটবলের অনন্য বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় এটি। তবে জোনাল মার্কিংয়ের উদ্ভবের পর আবেদন হারায়।

টোটাল ফুটবলের আইকন ইয়োহান ক্রুইফ। ছবি: এএস
টোটাল ফুটবলের আইকন ইয়োহান ক্রুইফ। ছবি: এএস

টোটাল ফুটবল:
ইন্টার মিলানকে ৫ আর এসি মিলানকে ৬ গোলে হারিয়ে টোটাল ফুটবলকে জনপ্রিয় করে তোলে আয়াক্স। কিন্তু এর উদ্ভব হয়েছিল ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের (৫০-এর দশকের হাঙ্গেরি জাতীয় দল) হাতে। এ দলের ফেরেঙ্ক পুসকাস বা কিংবা ’৭০ দশকের হল্যান্ডের ইয়োহান ক্রুইফরা মাঠজুড়ে খেলতে পছন্দ করতেন। একজন খেলোয়াড় জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এলে অন্যজন সে জায়গা নিতেন। এই কৌশলে কোচ রিনাস মিকেলসের আয়াক্স টানা ৩টি ইউরোপিয়ান শিরোপা জিতেছিল। কোচ ক্রুইফের ‘ড্রিম টিম’ বার্সেলোনায় টোটাল ফুটবল খেলা হতো ৩-৪-৩ ফর্মেশনে। যার মধ্যমণি ছিলেন মিডফিল্ডার পেপ গার্দিওলা।

টিকিটাকা খেলেই মৌসুমে ছয়টি শিরোপা জিতেছিল বার্সেলোনা। ছবি: গোলপ্রফিটস
টিকিটাকা খেলেই মৌসুমে ছয়টি শিরোপা জিতেছিল বার্সেলোনা। ছবি: গোলপ্রফিটস

টিকি-টাকা:
পেপ গার্দিওলার আরেকটি জনপ্রিয় উদ্ভাবনী কৌশল। ছোট ছোট পাসের মাধ্যমে অসংখ্য ত্রিভুজ তৈরি করে বল দখলে রাখা, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য। লুই আরাগোনেজ, ভিসেন্তে দেল বস্ক কিংবা গার্দিওলার সময়ে টিকি-টাকা সফল হয়েছে স্পেন ও বার্সেলোনা দলে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর দুর্বলতাগুলোও ধরা পড়ে। যার কারণে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ৭ গোল হজম করেছিল বার্সা আর ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল স্পেন।

ক্লপের অধীনে হাই-প্রেসিং খেলে সাফল্য পেয়েছিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। ছবি: ডিএফবি
ক্লপের অধীনে হাই-প্রেসিং খেলে সাফল্য পেয়েছিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। ছবি: ডিএফবি

হাই প্রেসিং:
এই তালিকার একমাত্র কৌশল, যার সুনির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নেই। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য বিপক্ষ দলকে ওপরে উঠে ট্যাকল করা। কোনো দল গোলরক্ষক পর্যন্ত এগিয়ে ট্যাকল করে, কেউবা মাঝমাঠ পর্যন্ত। মার্সেলো বিয়েলসাকে প্রেসিংয়ের গুরু বলা যায়, যার মাধ্যমে তিনি আবিষ্কার করেন ৩-৩-৩-১ ফর্মেশন। তাঁর দেখানো পথে হাঁটছেন টটেনহামের মরিসিও পচেত্তিনো, আর্জেন্টিনার কোচ হোর্হে সাম্পাওলিরা। লিভারপুল বস ইয়ুর্গেন ক্লপও বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে প্রেসিং ব্যবহার করেছেন। মাঠের পুরো দৈর্ঘ্য কাজে লাগিয়ে দ্রুতগতিতে আক্রমণ করত সেই দলটি। আবার প্রতিপক্ষকে আক্রমণে আসতে দিয়ে মাঝমাঠে প্রেসিং কমিয়ে দিত। এত করে নিজেদের বক্স থকে বুলেটগতিতে প্রতি আক্রমণে উঠতেন মার্কো রয়েস, রবার্ট লেভান্ডফস্কিরা। এ কৌশলেই ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ মৌসুমে বুন্দেসলিগা জিতে ডর্টমুন্ড। চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালেও উঠেছিল।

দিন দিন খেলোয়াড়দের ফিটনেস বাড়ছে। সামনে হয়তো প্রেসিংয়ের বিভিন্ন রূপ দেখা যাবে। তবে কোনো কৌশলই তো নিশ্ছিদ্র নয়। একেকটি কৌশলের ফাঁক গলেই বেরিয়ে আসে নতুন কৌশল, চমকপ্রদ সব ধারণা। সূত্র: ফুটবল ডেইলি