'গেইলের সঙ্গে আমার একটা মিল আছে'

>

মাশরাফি বিন মুর্তজা
মাশরাফি বিন মুর্তজা

ব্রেন্ডন ম্যাককালাম রান পাচ্ছেন না। অধিনায়ক পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘চিন্তা করো না। তুমি সব ম্যাচ খেলবে...।’ ব্যাট হাতে উইকেটে যাচ্ছেন ক্রিস গেইল। পেছন থেকে লাইসেন্স দিলেন অধিনায়ক, ‘প্রাণ খুলে ব্যাট করো...।’ বিপিএলে গেইল-ম্যাককালামের অধিনায়ক  মাশরাফি বিন মুর্তজা জানালেন টি-টোয়েন্টির দুই মেগাস্টারকে সামলানোর কথা। রংপুর রাইডার্সকে চ্যাম্পিয়ন করার রহস্যও।

প্রশ্ন: পাঁচটি বিপিএলের মধ্যে চারটিতেই চ্যাম্পিয়ন মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। অধিনায়ক মাশরাফির হাতে আসলে কী জাদু আছে?

মাশরাফি বিন মুর্তজা: এসব টুর্নামেন্টে অনেক বিদেশি খেলোয়াড় খেলে। বিপিএলে দুবার প্রতি দলে পাঁচজন করে বিদেশি খেলানোর নিয়ম ছিল, তার মধ্যে এবার একবার। প্রথমবার এবং এবার আমার দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশিদের বিরাট ভূমিকা ছিল। অন্য দুবার স্থানীয়রা ভালো খেলেছে। এবারও অবশ্য মিঠুন, রুবেল, গাজী (সোহাগ) খুব ভালো খেলেছে। অপু তো অসাধারণ বোলিং করেছে। সঙ্গে গেইলের দুটি ইনিংস, চার্লসের একটি ইনিংস ও ম্যাককালামের দুটি ইনিংস হয়তো আমাদের কাজ সহজ করেছে। কিন্তু শেষ চারে আসার আগে স্থানীয়রাই ভালো খেলেছে।

প্রশ্ন: অধিনায়ক হিসেবে আপনার ভূমিকাটা কোন জায়গায়?

মাশরাফি: এখানে অধিনায়কের কাজ হলো দলটাকে এক সুতোয় গাঁথা। একেকজন একেক জায়গা থেকে আসে। তাদের দল হিসেবে ধরে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবার শুরুতে আমাদের ভালো সময় যাচ্ছিল না। খেলোয়াড়দের তখন বোঝাতে হয়েছে, ‘খারাপ সময় যাচ্ছে মানে এই নয় যে, সবাই তোমাদের দোষ দিচ্ছে। স্বাধীনতা নিয়ে খেলো, মন যেভাবে চায়, সেভাবে খেলো।’ দলের মধ্যে এই পরিবেশ তৈরি করাটাই মূল কাজ ছিল।

ওদের মতো খেলোয়াড়দের এর চেয়ে বেশি বলারও দরকার নেই। গেইল-ম্যাককালামরা জানে, তাদের কী করতে হবে
ওদের মতো খেলোয়াড়দের এর চেয়ে বেশি বলারও দরকার নেই। গেইল-ম্যাককালামরা জানে, তাদের কী করতে হবে

প্রশ্ন: ভালো খেলোয়াড়, বিদেশি তারকা তো সব দলেই ছিল। কিন্তু তাদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনার জন্য আপনাকে কী করতে হয়েছে? আপনার দলে তো ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মতো খেলোয়াড়ও ছিলেন...

মাশরাফি: তাদের সঙ্গে আমি যখনই কথা বলেছি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলেছি। টিম মিটিংয়েই হোক বা ব্যক্তিগতভাবে। এখানকার উইকেট, আবহাওয়া, এখানকার চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে তারা আমাদের চেয়ে ভালো জানে না। কাজেই আমাদেরই আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে হবে এবং আমি সেভাবেই বলতাম। তাদের সঙ্গে সবকিছু নিয়ে কথা বলতাম। অন্য দলে খেললে ম্যাককালামকে হয়তো একপর্যায়ে ড্রপই দিয়ে দিত। টানা ৮-৯ ম্যাচে তো সে কোনো রানই করেনি। কিন্তু আমি এবং আমাদের কোচ...আমরা তাকে নিশ্চিত করেছি, ‘তুমি সব ম্যাচ খেলবে।’ আশ্বস্ত করেছি, ‘তুমি পারছ না বলে আমরা বা ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকেরা হতাশ, বিষয়টা এ রকম নয়। তুমি যেভাবে পারো নিজের খেলাটা খেলো।’ আমার ধারণা, এটাই কাজ করেছে ম্যাককালামের ক্ষেত্রে।

প্রশ্ন: গেইলের সঙ্গেও কি তাঁর খেলা নিয়ে কথা হতো?

মাশরাফি: সব সময়ই বলতাম। অনেক মজা করতাম তার সঙ্গে, সে-ও করত। গেইল খেলাটাকে ভাবে মানুষকে বিনোদন দেওয়ার একটা মাধ্যম। নিজেকে ভাবে একজন এনটারটেইনার। গেইলের সঙ্গে এই একটা জায়গায় আমার মিল আছে। এ নিয়ে কথা হতো। সে আমার চিন্তাভাবনার প্রশংসা করত। অনেক সময় ব্যাটিংয়ে নামার আগেও কথা বলেছি। আমি তাকে বলতাম, ‘প্রাণ খুলে খেলো। দলের কী অবস্থা, তুমি আউট হয়ে গেলে কী হবে—এসব ভাবার দরকার নেই।’ ওদের মতো খেলোয়াড়দের এর চেয়ে বেশি বলারও দরকার নেই। গেইল-ম্যাককালামরা জানে, তাদের কী করতে হবে।

প্রশ্ন: ড্রেসিংরুমে এ রকম খেলোয়াড় থাকলে স্থানীয় ক্রিকেটাররা নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত হন। কিন্তু উল্টোটাও কি হয় না? ধরুন তাঁদের ওপরই সবাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ল...

মাশরাফি: আমি তো বরং দেখলাম, প্রথম দিকে যখন বিদেশিরা রান করতে পারছিল না তখন স্থানীয়রাই এগিয়ে এল। তারা ভাবল, ‘আমাদেরই কিছু করতে হবে।’ গেইল-ম্যাককালামের মতো খেলোয়াড় থাকার পরও নিজেরা দায়িত্ব নিচ্ছিল। আমার কাছে এটা ইতিবাচক মনে হয়েছে। গেইলের ওই দুটি ইনিংস বাদ দিলে মিঠুনের পারফরম্যান্স অনেক ভালো। রুবেলের বোলিং দেখেন, মালিঙ্গার চেয়ে অনেক ভালো।

প্রশ্ন: গেইল, ম্যাককালাম দুজনই অনেক অভিজ্ঞ। বাংলাদেশি একজন অধিনায়ক হিসেবে যখন তাঁদের কোনো পরামর্শ বা নির্দেশনা দিতেন, তাঁরা সেটা কীভাবে নিতেন?

মাশরাফি: তারা যদি আমার কথা না-ও শুনত, আমার কিছু করার ছিল না। অধিনায়ক হিসেবে তবু আমাকে বলতেই হতো। তবে তারা সবকিছুই ভালোভাবে নিয়েছে। কোনো সমস্যা হয়নি। ওরা এ-জাতীয় টুর্নামেন্ট প্রচুর খেলে। তাদের ভিন্ন কিছু মনে হলে সেটাও সব সময় আমাকে বলেছে।

প্রশ্ন: ফাইনালে শেষ ওভারটা গেইলকে করতে দিলেন। জয় নিশ্চিত ছিল বলেই কি?

মাশরাফি: (হাসি) ও আমাকে বারবার বলছিল, ‘শেষ উইকেট আছে। মাত্র এক বল লাগবে। তুমি আমাকে বল দিচ্ছ না কেন? আমাকে বিশ্বাস করছ না!’ আমি বলেছি, ‘১৯তম ওভারেও তোমাকে বল দেব না। ১৯তম ওভারে নিশ্চিত হব যে, শেষ ওভারে ৩৬-এর বেশি রান লাগবে। তখন তোমাকে দেব।’ এরপর তো দিলাম শেষ ওভার।

প্রশ্ন: রংপুর রাইডার্স দলে একজন হাই প্রোফাইল কোচও ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া কেমন ছিল?

মাশরাফি: টম মুডি অনেক শক্ত কোচ। দল জিতলেও খুব উত্তেজিত হতেন না, আবার হারলেও তেমন মন খারাপ করতেন না। নিজের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, দল নির্বাচন করার সময় কোচ আমার ওপর কিছু চাপিয়ে দিতেন না। অনেক সময় হয়তো ফ্র্যাঞ্চাইজি কাউকে খেলানো ভালো মনে করল। কিন্তু কোচ আমাকে বলে দিতেন, ‘তোমার যদি এটাতে আস্থা না থাকে, তাহলে এটা করার দরকার নেই।’ আমি যে একাদশ নিয়ে মাঠে নামব, সেটা যেন আমার মনমতো হয়, সেই স্বাধীনতাটা দিতেন। যেমন আমি কয়েকটা ম্যাচে আগে ব্যাটিং করেছি। এ রকম যেটাতেই আমি আত্মবিশ্বাস দেখাতাম, কোচ সেটাই আমাকে করতে দিয়েছেন এবং সমর্থনও করেছেন।