দলটি ঢাকার ফরাশগঞ্জ, নাকি চেলসি বা পিএসজি?

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফরাশগঞ্জ দলের ওয়ার্মআপ। দেখা যাচ্ছে, এক খেলোয়াড়ের গায়ে পিএসজি ও দূরে দাঁড়ানো একজনের গায়ে চেলসির ট্র্যাকস্যুট। ছবি: প্রথম আলো
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফরাশগঞ্জ দলের ওয়ার্মআপ। দেখা যাচ্ছে, এক খেলোয়াড়ের গায়ে পিএসজি ও দূরে দাঁড়ানো একজনের গায়ে চেলসির ট্র্যাকস্যুট। ছবি: প্রথম আলো

গত সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডান স্পোর্টিং ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের মধ্যকার ম্যাচ চলছিল। খেলাটি চলার সময়ই দিনের দ্বিতীয় ম্যাচের জন্য ওয়ার্মআপে নামল একটি দল। কিন্তু কী আশ্চর্য! দলের এক খেলোয়াড়ের গায়ে পিএসজির ট্র্যাকস্যুট, দুজনের গায়ে চেলসির ট্র্যাকস্যুট। বাকিরা পরে ছিলেন ইউরোপীয় বিভিন্ন শীর্ষ ক্লাবের জার্সি কিংবা ট্র্যাকস্যুট। দেখে বোঝার উপায় ছিল না ওটা কোন দল! খেলার সূচি জানা থাকা দর্শকেরা একটু পরেই বুঝতে পারল, ওটা আসলে দ্বিতীয় ম্যাচের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল—ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ এ দেশের পেশাদার দল ও খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতা। কাগজে-কলমে এ দেশের ফুটবলে ১০ বছর আগে পেশাদারত্ব এলেও বাস্তবতা যে পুরোপুরি ভিন্ন, ফরাশগঞ্জ ক্লাবের খেলোয়াড়দের ‘রকমারি’ জার্সি ও ট্র্যাকস্যুটের সমাহার দেখেই তা বোঝা যায়। এই লিগে আসলে এখনো পেশাদারত্বের ‘প’ও আসেনি। জার্সি, ট্র্যাকস্যুটের কথা বাদ দিন, যে লিগ নির্ধারিত সূচি মেনে অনুষ্ঠিত হয় না, তাকে কীভাবে ‘পেশাদার’ বলা চলে। প্রতিনিয়ত এই লিগে সবাই মিলে নিয়ম ভেঙে থাকেন। ফেডারেশন, লিগ কমিটি থেকে শুরু করে ক্লাবগুলো যেন প্রতিযোগিতায় নামে, কে কত নিয়ম ভাঙতে পারে। সবকিছুই এখন গা-সহা। তাই বলে দেশের শীর্ষ লিগে খেলা একটি দল তার খেলোয়াড়দের জন্য নিজস্ব জার্সি-ট্র্যাকস্যুটের ব্যবস্থা করতে পারে না!

যেকোনো ফুটবল দলেরই ট্র্যাকস্যুট থাকে। শীতের দিনে এটা তো আরও বেশি প্রয়োজনীয়। ট্র্যাকস্যুট না থাকায় ফরাশগঞ্জের ফুটবলারদেরও মন খারাপ। অন্য দলের খেলোয়াড়েরা নাকি ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করেন। তবে দলের অধিনায়ক রাকিব খান ইভান জানালেন, খুব শিগগির তাঁদের ট্র্যাকস্যুট দেওয়া হবে, ‘ক্লাব কর্তৃপক্ষ আমাদের মাপ নিয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই পাব।’ প্রিমিয়ার লিগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের এসে দাঁড়িয়েছে। আর কদিন পরেই শিরোপা নির্ধারিত হয়ে যাবে। আর ফরাশগঞ্জের ফুটবলাররা ক্লাবের কাছ থেকে এখন ট্র্যাকস্যুট পাবেন! তাঁদের যে বাকিই আছে দুটি ম্যাচ।

মোহামেডান দলের অনুশীলন জার্সি। স্পষ্টত জার্সিটি জার্মানির। ছবি: সংগৃহীত
মোহামেডান দলের অনুশীলন জার্সি। স্পষ্টত জার্সিটি জার্মানির। ছবি: সংগৃহীত

ফরাশগঞ্জের ম্যানেজার বাবুরাম অবশ্য দাবি করেছেন ট্র্যাকস্যুট আছে, ‘ওদের ট্র্যাকস্যুট দেওয়া হয়েছে। খেলোয়াড়েরাই পরে আসে না মাঠে।’ খেলোয়াড়েরা বলছেন নেই, ম্যানেজার বলছেন আছে। কোনটা বিশ্বাস করা যাবে। এমনই বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী বাংলাদেশের ফুটবল।

ফরাশগঞ্জ বাংলাদেশের ফুটবলে একটি পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী দল। তারা ঘরোয়া ফুটবলের মধ্য-নিম্নমধ্য সারির দল হিসেবে সুপরিচিত। পুরোনো ঢাকার এই ক্লাব মাঝখানে বিরতি দিয়ে এবার আবার খেলছে প্রিমিয়ারে। কিন্তু দলের অবস্থা খুবই খারাপ। ‘পেশাদার’ লিগে খেললেও ফরাশগঞ্জের খেলোয়াড়েরা পারিশ্রমিক পান রীতিমতো পেটচুক্তির। শুরুতে অনুশীলনের জার্সিও ছিল না। খেলোয়াড়েরা নিজেরাই চাঁদা তুলে সেই জার্সির ব্যবস্থা করেছে। ট্র্যাকস্যুটের ব্যবস্থাও তারা করে ফেলত, কিন্তু খরচের ভয়ে করেনি। এসবের প্রভাব পড়েছে ফরাশগঞ্জের পারফরম্যান্সে। ২০ ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট তালিকার তলানিতে তাদের অবস্থান। চোখ রাঙাচ্ছে অবনমনের।

থিম্পুর চাংলিমিথাংয়ে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি পরিহিত আবাহনী দলের খেলোয়াড়েরা। ছবি: সংগৃহীত
থিম্পুর চাংলিমিথাংয়ে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি পরিহিত আবাহনী দলের খেলোয়াড়েরা। ছবি: সংগৃহীত

ফরাশগঞ্জই কেবল নয়; জার্সি-বিভ্রাটে থাকেন দেশের বড় ক্লাব আবাহনী-মোহামেডানের খেলোয়াড়েরাও। এই মৌসুমে মোহামেডান অনুশীলনে জার্মানির জার্সি ব্যবহার করছে। জার্মানির জার্সির বুকে কেবল মোহামেডানের লোগো এঁটে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছেন না খেলোয়াড়েরাও। ফুটবলার শাকিল বলেন, ‘মোহামেডানের মতো ঐতিহ্যবাহী দল নিজস্ব ডিজাইনে জার্সি তৈরি করতে পারে না? আগে তো এমন ছিল না। তবে আমরা খেলোয়াড়েরা সতর্ক থাকি। ভুলেও এই জার্সি পরে স্টেডিয়ামে যাই না। তাহলে লোকজন যে হাসবে।’

শুধু তা-ই নয়, মোহামেডানের ম্যাচ জার্সিতে ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দলের জার্সির ডিজাইন দেখা যায়। মোহামেডান কেবল সেই ডিজাইনের মধ্যে কালো রংটা বেছে নিয়েছে। এই হচ্ছে একটা দর্শকনন্দিত দলের পেশাদারত্ব।

আবাহনীর এসব ব্যাপারে সুনাম থাকলেও জার্সির ব্যাপারে অপেশাদরত্ব তারাও দেখিয়েছে। ২০১৪-১৫ মৌসুমে আবাহনীর অনুশীলন দেখতে গেলে অবাকই হতে হতো। তাদের অনুশীলনে যে ব্যবহৃত হতো রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি!

আবাহনী-মোহামেডানের মতো ক্লাবের জার্সি বাজারে বিক্রি হওয়ার কথা। ফ্যানবেজ তৈরির এটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তাদেরই এই অবস্থা। বাকিদের নিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলটা কীভাবে চলছে, সেটি তো বলাই বাহুল্য।