জর্জ উইয়াহর সঙ্গে কথা হয়েছিল নাসিরের

আবাহনীর লিগ জয়ে অসামান্য অবদান নাসিরের। ছবি: প্রথম আলো
আবাহনীর লিগ জয়ে অসামান্য অবদান নাসিরের। ছবি: প্রথম আলো

একটু পরপর ফোন বেজে উঠছে, ফোনটা কানে দিয়েই হাসিমুখে বলছেন, ‘ধন্যবাদ’, ‘ধন্যবাদ’। শীতের সকালে আবাহনী ক্লাব চত্বরে বসে বুঝতে অসুবিধা হলো না—অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছেন নাসিরউদ্দিন চৌধুরী। সেটিই তো হওয়া উচিত। গতকাল সন্ধ্যায় প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীকে শিরোপা জেতানোর পেছনে নাসিরের অবদান যে অনন্যই। এবারের লিগে ডিফেন্ডার হয়েও তাঁর গোল—৬টি। অনেকেই তাঁকে ডাকতে শুরু করেছেন আবাহনীর ‘সার্জিও রামোস’। রামোসের সঙ্গে নাসিরের কখনো দেখা হয়নি। তবে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল ‘ব্যালন ডি’অর’ বিজয়ী জর্জ উইয়াহর। তাঁর পরামর্শও পেয়েছিলেন নাসির।

কীভাবে দেখা হলো উইয়াহর সঙ্গে? সে আরেক কাহিনি। চট্টগ্রামের ছেলে নাসির একসময় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। উর্দি আর হেলমেট পরে হাতে অস্ত্র নিয়েই ছিল তাঁর কর্মজীবন। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে লাইবেরিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। সেখানেই উইয়াহর সঙ্গে দেখা। নাসির তখন নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছিলেন। বুকাচার সি পোর্ট নামের একটি জায়গায় উইয়াহ নাসিরের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেকোনোভাবেই লাইবেরীয় তারকা জেনেছিলেন নাসির সেনাবাহিনীর একজন ভালো ফুটবলার। নিজের খেলা উন্নত করতে উইয়াহর পরামর্শ পেয়েছিলেন। লাইবেরিয়ায় এই বিখ্যাত তারকার সঙ্গে মোট তিনবার দেখা হয়েছিল নাসিরের।
১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ভালো খেলোয়াড় হওয়ায় ২০০৫ সালেই লাইবেরিয়ায় শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো হয় তাঁকে। মিশনে গিয়েও অনুশীলন ছাড়েননি তিনি। যুদ্ধের ডামাডোলে মাঝে নিজের দায়িত্ব পালন করে প্রতিদিন এক ঘণ্টা ফুটবল অনুশীলন করতেন। ওই যে বুকে ছিল স্বপ্ন, জাতীয় দলে খেলতেই হবে। সেটি শেষ পর্যন্ত খেলতে পেরেছেন। তবে সেনাবাহিনীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়েই।
২০০৭ সালে সেনাবাহিনী ছাড়লেন। ক্লাব কাপে নাম লেখালেন ফেনী সকারে। ২০০৯ সালে মোহামেডানে নাম লেখানোর মধ্য দিয়েই শুরু হলো স্বপ্নপূরণের পথে যাত্রা। ২০১০ সালে সার্বিয়ান কোচ জোরান জর্জেভিচ তাঁকে ডাকলেন জাতীয় দলে। ভাগ্যের মারপ্যাঁচে জর্জেভিচই তাঁকে বানিয়ে দিলেন সেন্টারব্যাক। কী দেখে তাঁকে সেন্টারব্যাক বানিয়েছিলেন জর্জেভিচ? নাসির বলেন, ‘অনুশীলনে সুজন ভাইয়ের (জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক) সঙ্গে সেন্টার ব্যাকে খেলি। ম্যাচ শেষে কোচ বললেন, তুমি সেন্টারব্যাকে ভালো করবে। ওই থেকে আমি সেন্টারব্যাক।’
জাতীয় দলে অনেক দিন ধরেই খেলছেন। গত লিগ শেষে রব উঠেছিল ‌‘আর্মির নাসির’ ফুরিয়ে গিয়েছেন। ৩৮ বছর বয়স, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফুরিয়ে যাওয়ারই কথা। দলবদলের শেষ প্রান্তে চট্টগ্রাম আবাহনী থেকে জায়গা হলো আবাহনী লিমিটেডে। অর্জন করে নিলেন কোচ দ্রাগো মামিচের আস্থাও। না হলে কি আর সেন্টারব্যাক নাসিরকে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলাবেন আবাহনী কোচ? গতকাল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত ২১টি ম্যাচে মাত্র এক মিনিট ছিলেন তিনি মাঠের বাইরে। শুধু ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষে ব্যথা পেয়ে শেষ মিনিটে হয়েছিলেন বদলি। আবাহনীর কাছে নাসিরের গুরুত্বটা ছিল অন্য মাত্রারই। নাসির মাঠেই প্রমাণ করেছেন সবকিছু।
ডিফেন্ডার হয়েও লিগে ছয়টি গোল করে বাংলাদেশিদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, সংকটময় ম্যাচগুলোয় আবাহনীকে পার করেছেন। লিগে দেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ আটটি গোল করেছেন তৌহিদুল আলম সবুজ।
লিগের উদ্বোধনী ম্যাচে সাইফের বিপক্ষে ২-২ গোলে সমতা থাকা অবস্থায় ৮৫ মিনিটে গোল করে আবাহনীকে জিতিয়ে শুরু হয় নাসিরের গোলের অভিযান। এরপর চট্টগ্রাম আবাহনী ও গতকাল শেখ জামালও দেখল নাসিরের ম্যাচ বের করে নেওয়ার ক্ষমতা।
৩৮ বছর বয়সেও নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন নাসির। তিনি সৈনিক ছিলেন। সৈনিকের প্রত্যয়ই যে নাসিরের ফুটবল-শৈলীর বৈশিষ্ট্য।