সাকিব কেন সঙ্গীবিহীন?

সাকলাইন সজীব-সানজামুল ইসলামরা (ডানে) কি পারবেন লম্বা সময়ের জন্য বাঁহাতি স্পিনার সাকিবের সঙ্গী হতে? l প্রথম আলো
সাকলাইন সজীব-সানজামুল ইসলামরা (ডানে) কি পারবেন লম্বা সময়ের জন্য বাঁহাতি স্পিনার সাকিবের সঙ্গী হতে? l প্রথম আলো

স্পিন বোলিংটা বাংলাদেশের জন্য বাঁ হাতের খেল! এটাই বিশ্বাস ক্রিকেট বিশ্বের। এমন বিশ্বাসের কারণও আছে। যখন বাংলাদেশের কেউ ছিল না, তখনো ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। ১৫৩টি ওয়ানডে খেলা আবদুর রাজ্জাক তো প্রায় ১০ বছর এক প্রান্তে নির্ভরতার আরেক নাম হয়ে ছিলেন। সবশেষে সাকিব আল হাসান এসে আরও ভালোভাবে জানিয়ে দিলেন, বাঁ হাতে উইকেট নেওয়া আসলেই কত সহজ।

হ্যাঁ, ‘সবশেষে’ সাকিব। এমন নয় যে সাকিবের পর বাংলাদেশ দলে আর কোনো বাঁহাতি স্পিনার আসেননি। কিন্তু শুধু এসেছেনই, নির্ভরতা দিতে পারেননি। ঝরেও গেছেন অনেকে। সাকিবের অভিষেকের পর গত ১১ বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে বাংলাদেশের আরও সাত বাঁহাতি স্পিনারের। তাঁদের মধ্যে তাইজুল ইসলাম টেস্টে কিছুটা পাশে থাকলেও ওয়ানডেতে সাকিব অনেক দিনই সঙ্গীহীন। ২০১৪-এর পর থেকে বাঁহাতি স্পিনে দীর্ঘদিনের সঙ্গী রাজ্জাককে পাচ্ছেন না। এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছেন এই অগ্রজের একজন উত্তরসূরি খুঁজে পাওয়ার। কিন্তু অপেক্ষা আর ফুরোয় না। যে বাংলাদেশকে ক্রিকেট বিশ্ব চিনত বাঁহাতি স্পিনারের দেশ হিসেবে, তবে কি সেখানেই ভালো বাঁহাতি স্পিনারের আকাল পড়ে গেল! কেন? নতুন মুখদের সারিতে সর্বশেষ আসা সানজামুল ইসলাম কি পারবেন এই খরা দূর করতে?

বাঁহাতি স্পিনার সংকটের একটা কারণ হতে পারে দক্ষতার অভাব। ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, এমন কয়েকজন কোচ এবং বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলেছেন, এমন কয়েকজন বাঁহাতি স্পিনারের সঙ্গে কথা বলে এটাকেই মনে হয়েছে প্রধান কারণ। ঘরোয়া ক্রিকেটে যে দক্ষতা দিয়ে একজন বাঁহাতি স্পিনার সাফল্য পাচ্ছেন, সেটা যথেষ্ট হচ্ছে না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। স্পিনারদের জন্য বলের ফ্লাইট আর গতিতে বৈচিত্র্য থাকা জরুরি হলেও বেশির ভাগ বোলারের সেটিরই অভাব। নেই ছোবল মারার মতো বিষাক্ত টার্নও। উইকেট স্পিনবান্ধব না হলে সবাই যেন সাদামাটা বোলার। এখন পর্যন্ত একটি টি-টোয়েন্টি খেলা সাকলাইন সজীব, এমনকি অপেক্ষায় থাকা নাজমুল ইসলামের মধ্যেও আছে এই সমস্যা। বিদেশের মাটিতে সফল হওয়ার মন্ত্রটা তো কেউই ধরতে পারছেন না।

দু-একজন আবার সবই পারেন, শুধু সময়মতো বল ফেলার সঠিক জায়গাটি খুঁজে পান না। ক্রিকেটীয় ভাষায় ‘অ্যাকুরেসির অভাব।’ স্পিনাররাই বলেছেন, ভালো বল করার সামর্থ্য থাকার পরও এই সমস্যা থেকে যাওয়ার অর্থ একটাই—আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপ সামলাতে না পারা। উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে ইলিয়াস সানির কথা। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই ৬ উইকেট পাওয়ার পরও নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি সে কারণেই।

কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের পর্যবেক্ষণ, ওয়ানডের ফিল্ডিং বিধিনিষেধও বাঁহাতি স্পিনারদের সফল না হওয়ার একটি কারণ, ‘১১ থেকে ৪০ ওভারের মধ্যে মাত্র চারজন ফিল্ডার ৩০ গজের বাইরে রাখা যায়। খুব ভালো স্পিনার না হলে এ সময় সফল হওয়া কঠিন। ব্যাটসম্যানরা তখন দুই দিকেই শট খেলার প্রচুর সুযোগ পায়।’

সাকিবের মতো তিন সংস্করণেই ভালো বোলিং করেন, এমন বাঁহাতি স্পিনার না থাকাটাকেও তাঁর যোগ্য সঙ্গীর সংকটের কারণ মনে করেন অনেকে। অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ সব সংস্করণের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেও বাঁহাতি স্পিনে তাঁর মতো কেউ আসেনি। তবে তাইজুলকে নিয়ে সবাই আশাবাদী। ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসেবে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করার পরও কেন আর মাত্র ৩টি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, তা একটা রহস্য বটে।

তাইজুলের জন্য দুঃখ করে একসময় রফিকের অভাব ঘোচানোর আশা জাগানো এনামুল হক জুনিয়র বলেছেন, ‘হাথুরুসিংহের সময়ে বাঁহাতি স্পিনার নেওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড অনীহা তৈরি হয়। ওটাই ক্ষতি করেছে। রাজ (রাজ্জাক) ভাইকে একরকম জোর করেই দূরে রাখা হলো। তাইজুলকেও পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ তার সামর্থ্য আছে কিছু করে দেখানোর।’ সবাই এ ব্যাপারেও একমত যে, ওয়ানডেতে সাকিবের সঙ্গী হওয়ার সবচেয়ে ভালো সম্ভাবনা ছিল আরাফাত সানির। বলে বৈচিত্র্য অনেক। কিন্তু ২০১৬-এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বোলিং অ্যাকশনে ঝামেলা ধরা পড়ার পর তিনি এতটাই দূরে সরে গেছেন যে, এখন পর্যন্ত ফিরতে পারেননি জাতীয় দলে। ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে আসা সানজামুল ইসলামের মধ্যেও অনেকে সম্ভাবনা দেখছেন। ফ্লাইটে বৈচিত্র্য আছে। তা ছাড়া খেলা হবে ঘরের মাঠে। তাঁর বোলিংয়ের যে ধরন, সেটা এখানকার উইকেটে কার্যকর হওয়ার কথা।

হলে তো ভালো, না হলে সঙ্গীর জন্য সাকিবের অপেক্ষা দীর্ঘ হবে আরও। কিন্তু তিনি যে ১১ বছর ধরেই তিন সংস্করণে নির্ভরতার অদ্বিতীয় নাম হয়ে আছেন, সেটার রহস্য কী? সাকিবকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলছেন বুদ্ধিমত্তা আর সাহসের কথা। কোচ সরওয়ার ইমরানের বিশ্লেষণ, ‘পৃথিবীতে সম্ভবত সাকিবই একমাত্র বোলার, যে একটা বলে ছক্কা খেয়েও পরের বলটা ওই জায়গাতে করার সাহস রাখে। আর কোনো বোলার এটা করবে না। কিন্তু সাকিব জানে, পরের বলটা ব্যাটসম্যান কখনো একই জায়গায় আশা করবে না।’

আরেকজন সাকিব হয়তো বাংলাদেশ সহজে পাবে না, তবে বাঁ হাতের খেল দেখানো তাঁর একজন সঙ্গী কেন নয়? সেটির জন্য চাই স্পিনারদের জন্য বিশেষজ্ঞ কোচের তত্ত্বাবধান। ব্যাটসম্যানদের জন্য, ফাস্ট বোলারদের জন্য বিশেষায়িত ক্যাম্প হয়। সে রকম কিছু করা যায় স্পিনারদের জন্যও।

বাংলাদেশ যে এখনো বাঁহাতি স্পিনারের দেশই আছে, সেটি ঘরোয়া ক্রিকেটের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কিন্তু সঠিক পরিচর্যা না থাকলে হয়তো নকশিকাঁথার মতো বাঁহাতি স্পিনের স্বত্বটাও একদিন খোয়াতে হবে।