কষ্টটা রুবেল-সৌম্যরই সবচেয়ে বেশি

শেষ বলটির পর এভাবেই ভেঙে পড়েছিলেন সৌম্য সরকার। ছবি: এএফপি
শেষ বলটির পর এভাবেই ভেঙে পড়েছিলেন সৌম্য সরকার। ছবি: এএফপি
• অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছে রুবেল-সৌম্যকে।
• কেউ ভাবতেও পারেননি, কার্তিক নেমেই ছক্কা মারবেন।
• শেষ বলটি ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ইয়র্কার দিতে চেয়েছিলেন সৌম্য।


খেলা শেষে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা। ঘণ্টা চারেক পরই ফ্লাইট ধরার তাড়া। খানিকটা সময় পেয়ে দলের অনেকেই ঘুমিয়ে নিয়েছেন। তবে ঘুমাতে পারেননি রুবেল হোসেন, সৌম্য সরকার। উড়ানে চড়ার আগে কলম্বো বিমানবন্দরে দুজনকে দেখে মনে হলো দুর্যোগে বিধ্বস্ত জনপদের দুই বাসিন্দা। মনমরা চেহারা, মুখে কেমন অপরাধী অপরাধী ভাব!

এমন সময়ে বিমানবন্দরে আসতে হয়েছে, হালকা নাশতা করার সুযোগ হয়নি। বিমান ধরার আগে তাসকিন আহমেদ আর নুরুল হোসেন রুবেলকে নিয়ে এসেছেন ফাস্ট ফুডের দোকানে। ‘ভাই কিছু একটা খাও’—তাসকিন, নুরুল যতই অনুরোধ করেন, রুবেল ততই ‘না’ করেন। তাসকিন-নুরুল কিছু একটা মুখে দিলেও রুবেল খেলেনই না।
‘জেতা ম্যাচটা হারিয়ে দিলাম...’—রুবেলের গলাটা যেন ধরে আসে। ফাইনালের ১৯তম ওভারের দুঃসহ স্মৃতিটা বারবার মনে পড়ে রুবেলের। হয়তো এটা তাড়া করে ফিরবে তাঁকে আজীবন। নুরুল-তাসকিন পাশ থেকে সান্ত্বনা দেন, ‘না ভাই, তুমি তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করেছে। প্রথম তিনটা বল খারাপ করোনি। একটা ব্যাটসম্যান উইকেটে এসেই অমন ফুলটস বলে ছক্কা মেরে দেয়, এমন খুবই কমই হয়। আমাদের ভাগ্যটা সঙ্গে ছিল না।’

দিনেশ কার্তিক দ্রুত স্টান্স বদলে যে স্কুপটা করলেন, রুবেল কি ধরতে পারেননি ব্যাটসম্যানের নড়াচড়াটা? কার্তিক যদি তাঁকে বিভ্রান্ত করতে পারেন, তিনি কেন পারেননি ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করতে? ‘সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে যায় সবকিছু। ধরতে পারলে কি ওই বল দিই! খুব দ্রুত সময়ে সবকিছু নিখুঁতভাবে করাটা কঠিন। ইচ্ছে করে কেউ তো আর বাউন্ডারি খেতে চায় না’—অসহায় কণ্ঠে বলেন রুবেল।

রুবেলের ওই ব্যয়বহুল ওভারের পর ১২ বলে ৩৪ রানের সমীকরণটা পরে নেমে আসে ৬ বলে ১২। খণ্ডকালীন বোলার হিসেবে তীব্র স্নায়ুচাপে প্রথম পাঁচটি বলে একেবারে খারাপ করেননি সৌম্য। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান তাঁর হাতে বল তুলে দেওয়ার আগে বলেছেন, দরকার হলে সময় নিতে। তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই, প্রতিটি বল করতে হবে ভেবেচিন্তে। সৌম্য অধিনায়কের পরামর্শ মেনেই বোলিং করেছেন। ওভারের মাঝে যে চোখেমুখে পানি ছিটিয়েছেন, সেটি ওই ‘সময় নেওয়া’র অংশ হিসেবে।

বিমানে দেখা হলে বিষণ্ন মুখে সৌজন্য বিনিময় করলেন সৌম্য। শেষ বলটার পর উইকেটে পড়ে কেঁদেছেন। কেঁদেছেন মাঠ থেকে ফিরেও। ‘আমি ম্যাচটা হারিয়ে দিয়েছি’—এমন এক অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছে তাঁকে। শেষ বলটা একটা বাউন্সার দিলেই পারতেন! একটা বাউন্সার তো পাওনা ছিলই। ‘একজন স্লো মিডিয়াম পেসারের পক্ষে কার্যকর বাউন্সার দেওয়া কঠিন। পরিকল্পনা ছিল শেষ বলটা ওয়াইড ইয়র্কার দেব। যেহেতু জিততে হলে ব্যাটসম্যানকে ছক্কা মারতে হবে। ভেবেছিলাম যদি ভালোভাবে ওয়াইড ইয়র্কার দিতে পারি, ব্যাটের কানায় লেগে সর্বোচ্চ চার হবে। সেটি হলেও ম্যাচ টাই। কিন্তু বলটা জায়গামতো পড়েনি। আর ছক্কাটাও সে মেরেছে একেবারে মাপা। কোনোভাবে দড়ির ওপারে গিয়ে পড়েছে’—স্নায়ুক্ষয়ী শেষ মুহূর্তের পরিকল্পনাটা বলছিলেন সৌম্য।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরেকটি বেদনার গল্প হয়ে রইল ভারতের বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল। আর সেই বিয়োগান্ত গল্পের সবচেয়ে আলোচিত দুই চরিত্র সৌম্য-রুবেল। দুজনের কেউ নিশ্চয়ই দলকে হারাতে বোলিং করেননি। শেষ মুহূর্তে দলকে জেতানোর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, হয়নি—পরাজয়ের দুঃখবোধ, কষ্ট আর সবার চেয়ে তাঁদেরই বেশি।