অমীমাংসিত রইল সেই রশিদ-ধাঁধা

আফগান লেগ স্পিনার রশিদ। ছবি: আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড
আফগান লেগ স্পিনার রশিদ। ছবি: আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড

হার–জিত ছাপিয়ে মঙ্গলবার বারবার মনে ভেসে উঠছিল ভাগবত চন্দ্রশেখরের মুখ। 

বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচে প্রাচীনকালের ভারতীয় স্পিনার চন্দ্রশেখরের উদয় হচ্ছেটা কী করে? খুবই স্বাভাবিক এবং ন্যায্য প্রশ্ন। উত্তরটাও সহজ। রশিদ খানের দৌলতে। ভারতের বিখ্যাত স্পিনার–চতুষ্টয়ের অন্যতম চন্দ্রশেখর যতটা ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ছিলেন, রশিদ খানও ঠিক ততটাই।
চন্দ্রশেখরের ডান হাতটা ছিল বাঁ হাতের চেয়ে সরু ও দুর্বল। কিন্তু সেই দুর্বলতা কাটিয়ে বেশ খানিকটা দৌড়ে তিনি লেগ ব্রেক করাতেন। রুগ্‌ণতাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর শক্তি ও সম্পদ। তাঁর বলে গতি থাকার জন্য কোনোটা স্পিন হচ্ছে আর কোনটি সিমের ওপর কাট করাতেন, বোঝা দুষ্কর হতো। চন্দ্রশেখরের মতো অতটা দৌড়ে রশিদ বল করেন না। কিন্তু অর্থোডক্স লেগ স্পিনারের চেয়ে তাঁর বলের গতি বেশি। এই গতির দরুন কোনটা লেগ স্পিন আর কোনটাই–বা গুগলি অথবা স্ট্রেটার, ঠাওর করা কঠিন হয়ে যায়। ঠিক যেমন চন্দ্রশেখরকে ঠাওর করা কঠিন ছিল।

সেই কালে প্রযুক্তি আজকালের মতো উন্নত ছিল না। চন্দ্রশেখর তাই চিরকালের ধাঁধা রয়ে গিয়েছিলেন। মাত্র ৫৮ টেস্ট খেলে ২৪২ উইকেট নিয়ে তিনি খেলা ছেড়ে দেন। আজকালকার দিনে সেই সৌভাগ্য রশিদের অবশ্যই হবে না। কম খেলছেন। এক্সপোজার কম। অথচ অফুরন্ত বিস্ময়। রশিদ তাই এখনো কুহেলিকা। কিন্তু এখনই তাঁর বোলিং নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গেছে। ডিসেকশন টেবিলে তাঁকে ফেলা হচ্ছে। যে মায়াজাল তিনি ছড়িয়ে চলেছেন, সেই রহস্য ভেদ করতে বিশেষজ্ঞরা উন্মুখ। আজ যেমন অনেক বিখ্যাত স্পিনারই ধারে ও ভারে ভোঁতা, নখদন্তহীন বাঘ, হতে পারে রশিদও একদিন সেই পর্যায়ে চলে যাবেন।

কিন্তু সেই দিন আসার আগ পর্যন্ত রশিদ ভয়ংকর, গা ছমছমে অথচ সুন্দর। বাংলাদেশ ইনিংসের ১৬তম ওভারটা ছিল রশিদের তৃতীয়। ১১তম ওভারে চার রান দিয়েছেন। ১৪–তে পাঁচ রান। তামিম ও সাকিব তাঁকে সেভাবে খেলছেন যে সাবধানতায় এক পশলা বৃষ্টির পর শেওলা ধরা উঠোনে মানুষ পা ফেলে। কিন্তু তিনি যে রশিদ খান। বিস্ময়ের যে জাল ফাঁদ হিসেবে এত দিন তিনি পেতে এসেছেন, নিজেকে যে উচ্চতায় স্থাপন করেছেন, তার প্রতি সুবিচার করতে না পারলে মিথটা যে ভেঙে যায়? গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে ১৬তম ওভারটাকেই তিনি বেছে নিলেন। প্রথম বলে সাকিব, চতুর্থ ও পঞ্চম বলে তামিম ও মোসাদ্দেক। প্রথম ম্যাচের মতো এদিনও হ্যাটট্রিকের মুখোমুখি। সেটা হলো না ঠিকই, তবে বাংলাদেশের শিরদাঁড়া সেই যে ভেঙে গেল, আর কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলেন না। ১০১-৪ থেকে ১০৮-৮ হয়ে গেল পলকের মধ্যে। অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। ভালো লাগে না শুধু এটা ভাবতে, সেই অনিশ্চয়তা কেন বারবার বাংলাদেশকে ঘিরে থাকে।

বাংলা ইনিংসের ১৭তম ওভারের পর ১৮–য় রশিদ যখন সাবধানী সৌম্যর বেড়া ভেঙে দিলেন, তখন হুট করে অর্থনীতির ‘ল অব ডিমিনিশিং রিটার্নন্স’ তত্ত্বটি কেন যেন মনে উদয় হলো। তত্ত্ব অনুযায়ী, বেশি ইনপুট দেওয়ার অর্থ বেশি উৎপাদন নয়। বাংলাদেশকে ঘিরে আবেগের তীব্রতা বাড়ছিল, প্রত্যাশা বাড়ছিল, খেলোয়াড়দের তাগিদ বাড়ছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণের তীব্রতাও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আমরাও তাই ভাবছিলাম দ্বিতীয় ম্যাচে জিতে বাঙালি তার মুখ ও মান রক্ষা করবে। কিন্তু ওই যে অর্থনীতির তত্ত্বটা, ওটাই সবকিছু গুলিয়ে দেওয়ার জন্য উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল। প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশ করেছিল ১৪৫, দ্বিতীয় ম্যাচে ১২২। তৃতীয় ম্যাচে স্কোর তবে কি তারও কম? তাই যদি হয়, তাহলে কোথায় লুকাব সেই লজ্জা? এই ভাবনা থেকে রনি ও নাজমুল মুক্তি দিলেন বটে, কিন্তু অতি সাবধানতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেল না। ১২০ বলের খেলার মধ্যে ডট বলের হাফসেঞ্চুরি কী করে করা সম্ভব, সেই ধাঁধার উত্তরটাও অমিল থেকে গেল।

কথায় বলে, বন্যার তোড়ের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে। অনেক সলাপরামর্শ শেষে বাড়তি একজন ব্যাটসম্যান নিয়ে বাংলাদেশ মুখ ও মান রক্ষায় নেমেছিল। ম্যাচটা সমান–সমান হলে বৃহস্পতিবারের আকর্ষণের জন্য কিছু একটা থাকত। এই মধ্যরাত্রে ১৯ বছরের ছোকরা রশিদকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে, ওহে, জয়ীদেরই তো উদার হতে হয়! এটুকু উদারতা কি দেখাতে পারতে না যাতে তৃতীয় খেলাটার একটা মূল্য থাকত?