বিশ্বকাপ জিততেই পারে যে দল

রেড ডেভিলদের আশা-ভরসা দলটার ওপরেই। ছবি: রয়টার্স
রেড ডেভিলদের আশা-ভরসা দলটার ওপরেই। ছবি: রয়টার্স

ইউরোপে প্রথম দেশ হিসেবে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে বেলজিয়াম সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৬৪ সালে। ১৯০৪ সালের ১ মে প্রথম ইউরোপের দুই দল ফ্রান্স ও বেলজিয়াম আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামে। সেই ম্যাচ ৩-৩ গোলে ড্র হয়। কিন্তু ইউরোপে শক্তিশালী দলের কথা আসলে তবু বেলজিয়ামের নাম তেমনভাবে আসে না।

ফুটবল খেলাটা সবার আগে শুরু করলেও বিশ্বকাপে ভালো খেলা শুরু ১৯৮২ বিশ্বকাপে। উরুগুয়েতে প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে প্রথম পর্ব থেকেই বাদ, পরের দুই বিশ্বকাপেও একই অবস্থা তাদের, প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়। ১৯৫০ সালে বাছাইপর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও শেষ মুহূর্তে বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় রেড ডেভিলরা। চার বছর পর ফেরার বিশ্বকাপটাও রাঙাতে পারেনি তারা।

এক কথায় বেলজিয়ামের বিশ্বকাপের অর্জন খুবই নগণ্য। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল পর্যন্ত যাওয়াই সবচেয়ে বড় অর্জন। দীর্ঘ যাত্রাপথের হাজার ব্যর্থতার গল্পে একটু আশার প্রদীপ যেন জেগে উঠেছে বৈকি, কিন্তু তা-ও দমকা হাওয়ায় নিভে গেল। ১৯৮৬-এর পর সাতটি বিশ্বকাপ খেলে একবার কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল তারা। 

১৯৮৬-এর পর দেশটির ইতিহাসে সেরা দল নিয়ে ব্রাজিল যাত্রা করেছিল বেলজিয়ানরা। সেই সোনালি প্রজন্মের হাতে করে নিজ দেশে এক বিশ্বকাপ আসবে, সেই স্বপ্ন ছিল সবার চোখে মুখে। গত বিশ্বকাপে নিজেদের সেরা দল নিয়ে গিয়েও স্বপ্নযাত্রা থামাতে হয় কোয়ার্টার ফাইনালেই, লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার বিপক্ষে।

এই দলটাই এই শতাব্দীর শুরুতে খাবি খাচ্ছিল, বুঝতে পারছিল না কী করা উচিত। তখন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো শুরু করেন বেলজিয়াম ফুটবলের সাবেক টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর মাইকেল স্যাবলোন। সহ-আয়োজক হওয়ায় ১৯৯৮ বিশ্বকাপ আর ২০০০ ইউরোতে খেলার সুযোগ পায় বেলজিয়াম, কিন্তু বরাবরের মতোই বাদ। স্যাবলোন তখন ঘোরা শুরু করেন ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসের ক্লাবগুলোতে। সেখান থেকেই একটা বুদ্ধি নিয়ে শুরু করলেন বেলজিয়ামের নতুন করে পুনর্জাগরণ। এক কথায় বলতে গেলে, তারই পরিণতি হচ্ছে আজকের সোনালি প্রজন্ম।

ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের সেরা ট্রেনিং সেন্টারগুলো ঘুরে দেখেন সব জায়গাতেই একইভাবে খেলা হচ্ছে। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্কুল থেকে শুরু করে যুব-পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরে ৪-৩-৩ পদ্ধতির ফুটবল খেলা চালু করেন। সব পর্যায়ের কোচদের পর্যন্ত শেখানো হয়েছিল ৪-৩-৩ ফর্মেশন।

বড় ভরসার জায়গা মাঝমাঠের তিন সেনানী। ছবি: সংগৃহীত
বড় ভরসার জায়গা মাঝমাঠের তিন সেনানী। ছবি: সংগৃহীত

১৫০০-এর ওপর খেলার ভিডিও পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, পুরো সময়ে একেকজন খেলোয়াড় ৫-৬ বার বল পায়ে পায়, তাতে খেলার মান কমে যাচ্ছে। যে কারণে দলকে জিততে হবে মানসিকতা বাদ দেন। এর চেয়ে জোর দেওয়া হয় প্রতিটি পজিশনে ভালো খেলোয়াড় বের করার চিন্তায়।

স্যাবলোন সব জায়গায় নির্দেশ দিয়ে দিলেন, যেকোনো উপায়ে জিততে হবে মানসিকতা ত্যাগ করে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে হবে। আর নতুন নিয়মে অনূর্ধ্ব-৭ এবং অনূর্ধ্ব-৮ দলের লিগে কোনো পয়েন্ট তালিকা রাখা হবে না। আর কোনো তরুণ খেলোয়াড় একবার ওপরের স্তরে উঠে গেলে, তাদের আর নিচে ফেরার ভয় নেই। তাদের আর কখনোই নিচের স্তরে এসে খেলা লাগবে না।

স্যাবলোনের এই বুদ্ধিমত্তা বিফলে যায়নি। তার ফল হিসেবেই ভালো ভালো খেলোয়াড় উঠে এসেছে প্রতিটি পজিশন থেকেই। এই বিশ্বকাপের কালো ঘোড়া নামটা এবারও বেলজিয়ামের পাশেই।

নিচ থেকে ধরলে গোলবারে থিবো কোর্তোয়া। বিকল্প হিসেবে সিমন মিনিয়োলেত, কোয়েন কাস্তিলস দুজনেই আছেন।

রক্ষণভাগের কথা এলে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কথাটা আসে, ‘একটি ভালো আক্রমণভাগ তোমাকে ম্যাচ জেতাবে, কিন্তু ভালো রক্ষণ তোমাকে জিতাবে ট্রফি।’ সেদিক থেকে রক্ষণও শক্তিশালী বেলজিয়ামের। টটেনহামের দুই সেন্টার ব্যাকের কাছে থাকবে গুরুদায়িত্ব। ভার্তোনে এবং অলডারভেইরেল্ড যেকোনো আক্রমণভাগ দমাতে সক্ষম। চোটমুক্ত থাকলে ভিনসেন্ট কম্পানি থাকবেনই।

৩-৫-২ পদ্ধতিতে মাঝমাঠে ডানে টমাস মনিয়ের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে সবচেয়ে বেশি গোল বানিয়ে দিয়েছেন (৭টি)। ডানে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই পিএসজির ডিফেন্ডার তা বোঝাই যাচ্ছে। গোল বানানো নয়, গোল করতেও পটু মনিয়ের। বাছাইপর্বে এক হ্যাটট্রিকসহ করেছেন সর্বমোট ৫ গোল। বামে থাকবেন সদ্য চীনে পাড়ি জমানো ইয়ানিক কারাসকো। মাঝে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে রাদজা নাইনগোলানকে অনেকেই মিস করবে, কিন্তু মারুয়ানে ফেলাইনি তার জায়গা পূরণে সক্ষম। লিগে যে রকমই হোক, জাতীয় দলে তাঁর মানের খেলোয়াড় কমই আছে। সামনে হ্যাজার্ড আর কেভিন ডি ব্রুইনা থাকাতে মিডফিল্ড নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। অন্যদিকে, আক্রমণভাগ শুরু হবে রোমেলু লুকাকুকে দিয়ে। বিগম্যাচে ফ্লপ, নামের পাশে এই বাজে কথা থাকলেও জাতীয় দলের জার্সিতে এখনো তিনি অসাধারণ। বাছাইপর্বে করেছেন মোট ১১ গোল। আরেকজন ফরোয়ার্ড হিসেবে থাকতে পারেন নাপোলির দ্রিস মের্তেন্স। বাছাইপর্বে ৫ গোল এবং ৬ এসিস্টের করে আছেন ফর্মে তুঙ্গে। বেলজিয়াম শেষবারের মতো হারের মুখ দেখেছিল প্রায় ২ বছর আগে, স্পেনের সঙ্গে। ২-০ ব্যবধানে সে হারের পর টানা ১৬ ম্যাচ অপরাজিত তারা।

পৃথিবীর ওপর থেকে স্যাটেলাইটে সবচেয়ে উজ্জ্বল দেশটার নাম বেলজিয়াম। রাতে দূর থেকে রাস্তার আলোতে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল লাগে বেলজিয়ামকেই। নিউইয়র্ক টাইমস অনুযায়ী, বেলজিয়ামের রাস্তার পাশেই বাতি আছে প্রায় ২২ লাখ। পৃথিবীর সবচেয়ে উজ্জ্বল দেশটা, জয় করতেই পারে বিশ্বকাপ। তাদের স্লোগানটাও সে রকমই, ‘অসম্ভবকেই প্রত্যাশায় রাখো!’