স্পেনেই শেষ হবে রাশিয়ার স্বপ্নযাত্রা?

প্রিয়জনের কপালে চুমু! রামোসের দলের সামনে আজ বাধা রাশিয়া। ছবি: রয়টার্স
প্রিয়জনের কপালে চুমু! রামোসের দলের সামনে আজ বাধা রাশিয়া। ছবি: রয়টার্স
>বিশ্বকাপে লাল রং এখনো ছড়িয়ে রেখেছে রাশিয়া। কিন্তু আজ স্বাগতিকদের প্রতিপক্ষ যে স্পেন! রাশিয়া কি পারবে?

উরুগুয়ে গ্রুপের শেষ ম্যাচে রাশিয়ার ভেতরটাকে এমনভাবে খুঁচিয়ে বের করে এনেছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী রুশ নাগরিকও নিজেদের দল নিয়ে আর স্বপ্ন দেখছেন না। রুশ ফুটবল জনতার ধারণা, আজ স্পেনের বিপক্ষে ম্যাচেই মস্কোভা নদীতে রাশিয়ার স্বপ্নের সলিলসমাধি হবে।

স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে অন্য দেশের তরুণ-তরুণী আছেন, তবে সংখ্যায় কম। রুশরাই বেশি। স্পেন-রাশিয়া দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হওয়ার পর যে স্টেডিয়ামেই যাই, কথা বলার চেষ্টা করা হয় ওদের সঙ্গে। আসলে দৈবচয়ন ভিত্তিতে রাশিয়া দল নিয়ে রুশদের মনোভাবটা জানার চেষ্টা। কোথাও রাশিয়াকে নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস ধরা পড়ে না।

কাজানে এসে কথা হলো রিনাত ও এলেনার সঙ্গে। এলেনার ডেস্কের নিচে একটা ইংরেজি বই পড়ে রয়েছে—হাউ টু ইমপ্রুভ ইয়োর ইংলিশ ভোকাবুলারি। রিনাতও সাংবাদিকদের ফাইফরমাশ শোনার ফাঁকে গুগলে ইংরেজি অভিধান পড়ছে।

দ্বিতীয় রাউন্ডে রাশিয়ার সম্ভাবনা জানতে চাইলে সংবিৎ ফিরল ওদের। ‘নো হোপ...নো হোপ...’—আশা তুমি আজ বাস্তব নিরাশা। প্রতিপক্ষ স্পেন বলে কারও মুখেই সামান্যতম আশার বাণী নেই। স্পেন পাসিং ফুটবলের জাল বুনে গলা টিপে মারবে রাশিয়াকে, এমনই এক ভীতির বাতাবরণ মনের মধ্যে।

২৮ জুন রাশিয়ার অনুশীলনে এসেছিলেন গাস হিডিঙ্ক। টেকো মাথার স্তানিস্লাভ চেরচেশভের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর মতো করে অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য রেখেছেন ডাচ কোচ। অথই সাগরের সামনে দিশেহারা মানুষের এমন কিছু টনিক দরকার। রুশ কোচ ঠিক লোকটাকেই বেছেছেন। গাস হিডিঙ্কের হাত ধরেই তো অনন্য এক ইতিহাসে নাম লিখিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। র‍্যাঙ্কিংয়ে নিচের সারিতে, ফুটবল নিয়ে মাতামাতি নেই—এমন একটা দেশ সেমিফাইনাল খেলবে, ২০০২ বিশ্বকাপের শুরুতে কেউ এমন বললে নির্ঘাত মানসিক সুস্থতা নিয়ে সংশয় জাগত। কিন্তু হিডিঙ্কের হাত ধরে সেটাই করে দেখিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া—কোরিয়ানদের ভালোবাসার ‘হি-থিংক’।

রাশিয়াও আয়োজক, ফিফা র‍্যাঙ্কিং ৭০। প্রথম পর্বেই তাদের বিশ্বকাপ শেষ হবে ভাবা গেলেও তা হয়নি। প্রথম দুই ম্যাচেই আনন্দদায়ী প্রাণখোলা ফুটবল খেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে গেছে। এখন তো দরকার দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন। সেটি দেখতে না পেয়ে হিডিঙ্কও নিশ্চয়ই অবাক। এখানেই রুশ মানস আর কোরিয়ান মানসিকতার তফাত। কোরিয়ায় পুরোটা দিন, সারাটা রাত দলের পেছনে থাকত সে দেশের মানুষ। লাল সমুদ্র কখনো রাস্তা থেকে সরে যায়নি। কণ্ঠে বাজত অবিনাশী গান, ‘দে হান মিন গুক’।

রাশিয়ায় তা নয়। লাল-নীল-সাদা পতাকার সংখ্যা বেড়েছে। চেরিশেভ, গোলোভিনের নাম লেখা লাল জার্সিও উঠেছে অসংখ্য তরুণ-তরুণীর গায়ে। কিন্তু মাতামাতি নেই। উরুগুয়ের কাছে স্বপ্নটা ধাক্কা খাওয়ার পর রাশিয়া আবার বাস্তববাদী।

তবে কাজান অ্যারেনায় স্বাগতিক শহর কমিটির সদস্য আলেক্সান্দার নামের এক ভদ্রলোক পরশু যা বললেন, সেটি হতে পারে উপলব্ধির নির্যাস, ‘দেখুন, আমরা সবাই আমাদের দলকে ভালোবাসি। এ তো আমার জন্মভূমি। আমি চাই, খুব করে চাই রাশিয়া জিতুক। কিন্তু প্রতিপক্ষ যে স্পেন নামের ভয়ংকর দল। এ জন্যই স্বপ্নের লাগামটাকে আমরা টেনে ধরি। বেশি রং চড়াই না। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাটা বেশি করে বুকে লাগে। রুশরা তাদের মতো করে ভাবে।’

কী দারুণ ব্যাখ্যা! হঠাৎই চোখ চলে যায় লুঝনিকির গ্যালারিতে। পাল্টা–আক্রমণে ১০ জনের রাশিয়া গোলের কাছাকাছি গিয়েও গোল পেল না। মুহূর্তেই উরুগুয়েকে ৩-০ এগিয়ে দিলেন এডিনসন কাভানি। রাশিয়ার পতাকাটা বাতাসে দুলিয়েই চলেছেন এক তরুণী, কিন্তু চোখের কোণে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু। হেরেছ ক্ষতি নেই, তবু আমরা তোমাদের পাশে আছি। শক্তিধর দলের সঙ্গে আজ হয়তো পারোনি, ভবিষ্যতে পারবে—এই হতে পারে মনের ভাষা।

এই মনোভাব নিয়েই আজ লুঝনিকিতে যাবে রুশ জনতা। গ্যালারিতে লাল-সাদা-নীল রুশ পতাকার উচ্ছ্বাসও বইবে। লেনিনের ভাস্কর্যের সামনে ম্যাচের আগে উৎসবের ঢেউ ভেঙে পড়বে। কিন্তু স্পেনের কাছে হারে স্বপ্নযাত্রা থেমে গেলে চোখের জলে নদী হয়তো হবে না। রুশরা এমনই।

ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বকাপ শুরুর আগে খেলোয়াড়দের বলেছিলেন, ‘তোমরা বিশ্বকে খেলার মাঠেও দেখিয়ে দাও যে রাশিয়া বিশ্বকাপের যোগ্যতম আয়োজক।’ খেলোয়াড়েরা দলকে বাস্তবিক আশার বিপরীতে গিয়েই দলকে তুলেছেন দ্বিতীয় রাউন্ডে। পুতিনের আরেকটা নির্দেশ যদি তাঁদের আরেকটু উজ্জীবিত করে, তাহলে হয়তো বলা যায় না, ফুটবলের চিররহস্যময় কুঠুরিতে কী আছে লুকিয়ে। এই বিশ্বকাপই তো দেখাল জার্মান দেয়ালও ভেঙে পড়ে দুর্বলের হঠাৎ আঘাতে।

তবে রুশরা ধরেই নিয়েছে, স্পেনের সামনে কোনো মন্ত্রেই কাজ হবে না রাশিয়ার। আজই আয়োজকদের বিশ্বকাপ বিসর্জনের উৎসব। এরপর পড়ে থাকবে শুধু আয়োজনের দায়ভার। পতাকার সাদা রংটির মতো।