গোলরক্ষকের বীরত্বে ক্রোয়েশিয়া শেষ আটে

ক্রোয়েশিয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার নায়ক গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচ। ছবি: রয়টার্স
ক্রোয়েশিয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার নায়ক গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচ। ছবি: রয়টার্স
>বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় টাইব্রেকারে ডেনমার্ককে ৩-২ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল ক্রোয়েশিয়া। এই হারে শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিল ডেনমার্ক


বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে ক্রোয়েশিয়াকে কখনো এই পরীক্ষা দিতে হয়নি। সেটি স্নায়ুক্ষয়ী টাইব্রেকার পরীক্ষা। অতিরিক্ত সময়ে লুকা মডরিচের পেনাল্টি মিস ক্রোয়েশিয়াকে শেষ আটে এক পা দেওয়া থেকে পিছিয়ে সেই পরীক্ষায় নামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে ক্রোয়েশিয়াকে শেষ আটে তুলেছেন গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচ। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ স্বাগতিক রাশিয়া।

গোলরক্ষকদের দেয়াল হয়ে দাঁড়ানোর এই ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার শেষ ষোলো নিশ্চিত করেছেন ইভান রাকিতিচ।  তাঁর লক্ষ্যভেদেই টাইব্রেকারে ৩-২ গোলের জয়ে ’৯৮ বিশ্বকাপের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার পথে হাঁটা অব্যাহত রাখল ক্রোয়েশিয়ার সোনালি প্রজন্ম। এর আগে ম্যাচটা ১-১ গোলে অমীমাংসিত ছিল।

স্নায়ুক্ষয়ী এই টাইব্রেকারে প্রথম শটটা নেন ডেনিশ তারকা ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন। তাঁর শট ক্রোয়াট গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচের হাতে লেগে গোলপোস্ট কাঁপিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ক্রোয়েশিয়ার হয়ে প্রথম মিলান বাদেলির নেওয়া প্রথম শটটা অবশ্য রুখে দেন ক্যাসপার স্মেইকেল। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ডেনিশদের টাইব্রেকার পরীক্ষা পর্যন্ত তুলে এনেছিলেন স্মেইকেল। তবে স্মেইকেলের বীরত্ব মুছে এই ম্যাচটা নিজের করে নিয়েছেন সুবাসিচ।

এরপর ডেনিশ অধিনায়ক সিমোন ক্যার লক্ষ্য ভেদ করেন। ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায় ডেনমার্ক। ক্রামারিচ এসে লক্ষ্য ভেদ করে ক্রোয়েশিয়াকে ১-১ ব্যবধানে সমতায় ফেরান। ক্রন-দেলি ডেনমার্ককে আবারও এগিয়ে দেন ২-১ ব্যবধানে। মডরিচ এসে এবার আর কোনো ভুল করেননি। লক্ষ্য ভেদ করে ম্যাচে টিকিয়ে রাখেন ক্রোয়েশিয়াকে। কিন্তু নাটকের তখনো অনেক বাকি।

শেষ শটের লক্ষ্যভেদে শেষ আট নিশ্চিতের পর রাকিতিচের উল্লাস। ছবি: এএফপি
শেষ শটের লক্ষ্যভেদে শেষ আট নিশ্চিতের পর রাকিতিচের উল্লাস। ছবি: এএফপি

লাস শোনের শট রুখে দেন ক্রোয়াট গোলরক্ষক সুবাসিচ। পরের দফায় ক্রোয়াট জোসিপ পিভারিচের শটও ঠেকিয়ে দেন স্মেইকেল। ২-২ ব্যবধানে ম্যাচ তখনো অমীমাংসিত। এই অবস্থায় নিকোলাই হোর্গেনসনকেও রুখে দেন সুবাচিস। অর্থাৎ পরের শটে ক্রোয়েশিয়া লক্ষ্য ভেদ করলেই তারা উঠে যাবে কোয়ার্টার ফাইনালে। রাকিতিচ এসে ঠান্ডা মাথায় সেই কাজ সেরে ক্রোয়েশিয়াকে শেষ পর্যন্ত তুলেছেন শেষ আটে।

টাইব্রেকারে ৩-২ গোলের এই জয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর প্রথমবারের মতো শেষ আটের দেখা পেল ক্রোয়েশিয়া। এরই সঙ্গে তারা মনে করিয়ে দিল সুকার–বোবান–প্রসিনিস্কিদের সেই সোনালি প্রজন্মকে। ’৯৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে সেমিতে তুলেছিল তারা। মডরিচ–রাকিতিচদের প্রজন্ম যেন তাদের দেখানো পথেই হাঁটছে!

অতিরিক্ত সময়ের শুরুতে দারুণ দুটি আক্রমণ করেছে ডেনিশরা। কিন্তু গোল হয়নি। এই অর্ধের শেষ দিকে ডেনিশ রক্ষণভাগে বেশ চাপে রেখেছিলেন মডরিচ। মাঝমাঠ থেকে বল টেনে বেশ কয়েকবার ঢুকে পড়েছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে। শটও নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার কিংবা স্মেইকেল রুখে দিয়েছেন মডরিচকে।

১১৪তম মিনিটে টাইব্রেকার পরীক্ষা এড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন মডরিচ। দুর্দান্ত পাসটা এই ক্রোয়াট তারকাই দিয়েছিলেন। আন্তে রেবিচ সেই থ্রু ধরে একা পেয়ে গিয়েছিলেন গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মেইকেলকে। কিন্তু পেছন থেকে ফাউলের শিকার হন রেবিচ। পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। স্পটকিক থেকে মডরিচের শট ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে রুখে দেন স্মেইকেল। গ্যালারিতে তখন স্মেইকেলের বাবা পিটার স্মেইকেলের সে কী উল্লাস! ছেলে যে বাবার নাম রাখতে পেরেছেন! ডেনিশ গোলপোস্টে পিটার স্মেইকেলও একসময় আস্থার প্রতীক হয়ে ছিলেন।

এর আগে ম্যাচের শুরুতে নোভগোরাদে গ্যালারির দর্শকেরা তখনো থিতু হয়ে বসেননি। এরই মধ্যে গোল! সেটাও মাত্র ৬১ সেকেন্ডের মাথায়। ডান প্রান্ত থেকে ক্রোয়াট বক্সে লম্বা থ্রো বাড়িয়েছিলেন ডেনিশ ফুলব্যাক ইয়েনাস কনুদসেন। বলটা ঠিকমতো ‘ক্লিয়ার’ করতে পারেনি ক্রোয়াট রক্ষণ। জটলার মধ্যে থেকে শট নিয়েছিলেন ম্যাথিয়াস ইয়ুর্গেনসন। সেটা গোলে পরিণত হওয়ার পেছনে ক্রোয়াট গোলরক্ষক দানিয়েল সুবাসিচের অবদান রয়েছে।

সুবাসিচ আরেকটু ক্ষিপ্র প্রতিক্রিয়া দেখালে শুরুতেই ক্রোয়েশিয়াকে পিছিয়ে পড়তে হতো না। ১৯৯৮ টুর্নামেন্টে ব্রায়ান লাউড্রপের পর এই প্রথম বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে ডেনমার্কের হয়ে গোল করলেন ইয়ুর্গেনসন। তবে ডেনমার্কের এই এগিয়ে যাওয়া টিকে ছিল মিনিট দুয়েক। ডান প্রান্ত থেকে উড়ে আসা ক্রস ঠিকমতো ‘ক্লিয়ার’ করতে পারেনি ডেনিশ রক্ষণভাগ। বক্সের ভেতর থেকে ক্রোয়াট স্ট্রাইকার মারিও মানজুকিচ শট নিয়েছিলেন। পায়ে ঠিকভাবে লাগাতে না পারলেও বলটা ঠিকই জালে আশ্রয় নিয়েছে।

ম্যাচের ৪ মিনিটের মধ্যে দুই গোল দেখে দর্শকেরা হয়তো আশায় নড়েচড়ে বসেছিলেন। গোল উৎসব হবে! সেই কিন্তু আশায় গুড়েবালি। দুই দলের খেলোয়াড়েরাই বিশেষ করে ক্রোয়াট শিবির বেশ কিছু দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করেও এগিয়ে যেতে পারেনি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এ নিয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে দুই দলই ৪ মিনিটের মধ্যে গোলের মুখ দেখল। এর আগে সর্বশেষ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচে এমনটা দেখা গেছে।

সে যা–ই হোক, গ্রুপ পর্বে সব ম্যাচ জিতে শেষ ষোলোয় উঠে আসা ক্রোয়েশিয়া কিন্তু প্রথমার্ধেই এগিয়ে যেত পারত। ২৯ মিনিটে ইভান রাকিতিচ বক্সের বাইরে থেকে ডেনিশ গোলরক্ষক ক্যাসপার স্মেইকেলের সরাসরি শট নেন। বলটা বাঁক নেওয়াতে পারলে হয়তো স্কোরলাইন পাল্টাতে পারতেন রাকিতিচ। প্রথমার্ধের শেষ মুহূর্তেও একই রকম শট নেন রাকিতিচ।

তার আগে ৪০ মিনিটে ডেনমার্ককে গোল এনে দেওয়ার খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন। তাঁর নিখুঁত ক্রস ক্রোয়াট গোলবারের লেগে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। প্রথমার্ধে ৫৬ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে ৯টি শট নিয়েছেন লুকা মডরিচ-রাকিতিচরা। এর মধ্যে গোলপোস্টে ছিল ৩টি শট। ডেনমার্ক ৪টি শট নিয়ে ২টি শট রাখতে পেরেছে ক্রোয়াট গোলপোস্টে।

বিরতির পর আক্রমণের ধার বাড়িয়েছে ক্রোয়েশিয়া। বিশেষ করে ৭১ মিনিটে মাতেও কোভাচিচ বদলি হয়ে মাঠে নামার পর কয়েকটি ভালো আক্রমণ করেছেন জ্লাতকো দালিচের শিষ্যরা। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের মতো বক্সের বাইরে থেকে শট নিয়ে গোলের কয়েকটি চেষ্টা করেছেন মডরিচ। কিন্তু কোনোটাই জাল ছুঁতে পারেনি।