জাপানকে হারিয়ে রোমাঞ্চ জিতল বেলজিয়াম

ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে গোল করছেন শাদলি। এই গোলেই শেষ আটের দেখা পেয়েছে বেলজিয়াম। ছবি: এএফপি
ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে গোল করছেন শাদলি। এই গোলেই শেষ আটের দেখা পেয়েছে বেলজিয়াম। ছবি: এএফপি
>জাপানকে ৩-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে বেলজিয়াম।

স্বপ্নভঙ্গ বোধ হয় একেই বলে। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার প্রায় ১৭ মিনিট আগেও প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন দেখছিল জাপান। কিন্তু এই ম্যাচে দলটির বিধিলিপি লেখা ছিল অন্যভাবে। এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে শেষ ষোলোয় ওঠা জাপানকে যে এভাবে বিদায় নিতে হবে, তা কে ভেবেছে! যোগ করা সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে জাপানের সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে বেলজিয়ামের হার না মানা মানসিকতার কাছে হেরে।

স্কোরলাইন বলছে, ম্যাচটা ৩-২ গোলে জিতে শেষ আটে উঠেছে বেলজিয়াম। আর তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকেই বিদায় নিয়েছে জাপান। কিন্তু স্কোরলাইন এই ম্যাচের নাটকীয়তা বোঝাতে যথেষ্ট নয়। ম্যাচটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন, গতি, আক্রমণ আর পাল্টা–আক্রমণের পসরা সাজিয়ে বসেছিল দুই দল। বেলজিয়াম শুধু কাগজে-কলমেই জয়ী। আসল জয়ী তো ফুটবল—যেখানে জাপানের অবদানও কম নয়।

যোগ করা সময় থেকে শুরু করা যায়। ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে গড়াতে না দিতে দুই দলকে ৪ মিনিট সময় দিয়েছিলেন রেফারি। এই সময়ের মধ্যেই দুই দল তিনটি করে আক্রমণ করেছে। ভাবা যায়! এর মধ্যে তৃতীয় মিনিটে কিউসিকি হোন্ডার ফ্রিকিক দারুণ দক্ষতায় রুখে দেন বেলজিয়ামের গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া। তবে কোর্তোয়ার আসল ভেলকি অন্যখানে।

তাঁর সেই সেভ থেকে কর্নার পেয়েছিল জাপান। ২-২ গোলের গিঁট খুলতে সেই কর্নার তাঁরা কাজে লাগাতে পারেনি। উল্টো বলটা গ্রিপ করেই বিদ্যুৎগতিতে সতীর্থকে দিয়ে দেন কোর্তোয়া। বেলজিয়ামের এই গোলরক্ষক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বলটা দ্রুত না ছাড়লে বেলজিয়াম জয়সূচক গোলটা পেত না, বরং ম্যাচ গড়াত অতিরিক্ত সময়ে।

কিন্তু কোর্তোয়ার কাছ থেকে বল পেয়েই কাউন্টার অ্যাটাকে ওঠে বেলজিয়াম। কেভিন ডি ব্রুইনা থেকে বল পান টমাস মনিয়ের। ডান প্রান্ত থেকে তাঁর ক্রস রোমেলু লুকাকু ডামি করলে ফাঁকায় বল পেয়ে যান নাসির শাদলি। আলতো টোকায় বলটা জালে পাঠিয়ে তিনি বেলজিয়ামকে শুধু শেষ আটেই তোলেননি, সঙ্গে জাপানিজদের অশ্রুধারাও বইয়ে দেন।

ছবি কথা বলে। শেষ মুহূর্তের গোলে বেলজিয়ামের খেলোয়াড়দের একতাবদ্ধ উল্লাস। অন্যদিকে হারে বিধ্বস্ত জাপানের খেলোয়াড়েরা। ছবি: এএফপি
ছবি কথা বলে। শেষ মুহূর্তের গোলে বেলজিয়ামের খেলোয়াড়দের একতাবদ্ধ উল্লাস। অন্যদিকে হারে বিধ্বস্ত জাপানের খেলোয়াড়েরা। ছবি: এএফপি

বেলজিয়ামের জয়সূচক এই গোলের আগে থেকেই ম্যাচের চিত্রনাট্য হয়ে উঠেছে রোমাঞ্চকর নাটকের মতো। সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে পেন্ডুলামের মতো দুলেছে ম্যাচের ভাগ্য। ৪৮ মিনিটে বেলজিয়ামের ডিফেন্ডার ইয়ান ভার্তোনের ভুলের সুযোগে গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়াকে ফাঁকি দিয়ে গোল করেন গেঙ্কি হারাগুচি। ১-০ গোলে এগিয়ে যায় জাপান। ঠিক এর ৫ মিনিট পরই জাপানের এগিয়ে যাওয়ার ব্যবধান ২-০!

শিনজি কাগাওয়ার পাস থেকে ২৫ গজি শটে গোল করেন তাকাশি ইনুই। দুই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার পর স্বয়ং বেলজিয়ামের সমর্থকেরাই বাড়ির পথ দেখতে পেয়েছিলেন। কারণ, ১৯৬৬ টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগাল-উত্তর কোরিয়া (৫-৩) ম্যাচের পর বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে কোনো দলই ন্যূনতম দুই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পরে ৯০ মিনিটের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিততে পারেনি। কিন্তু লুকাকু-ভার্তোনে-ফেলাইনিদের হাল না ছাড়া মানসিকতার কাছে এসব তথ্য–উপাত্ত স্রেফ সংখ্যা হয়ে উড়ে গেছে।

পিছিয়ে পড়ার পর বারবার জাপানের রক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বেলজিয়ামের আক্রমণভাগ। এরই ধারাবাহিকতায় ৬৯ মিনিটে গোল করেন ইয়ান ভার্তোনে। উড়ে আসা বল ভালোভাবে ‘ক্লিয়ার’ করতে পারেননি জাপানের তাকাশি ইনুই। বাঁ প্রান্তে প্রায় ১৮.৬ মিটার দূর থেকে বাতাসে ভাসতে থাকা বলটা ভার্তোনে জালে পাঠিয়েছেন হেড করে!

১৯৯৬ টুর্নামেন্ট থেকে খুঁটিনাটি তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ চালু হওয়ার পর বিশ্বকাপে এটাই সবচেয়ে বেশি দূরত্ব থেকে হেডে করা গোল। গ্যালারিকে অবাক করে দেওয়া এই গোল করে ভার্তোনে কি নিজেও কিছুটা অবাক হয়েছিলেন? কোনো অভিব্যক্তি ছিল না তাঁর মুখে। হয়তো যত দ্রুত সম্ভব ম্যাচে ফেরার তাড়া খেলা করছিল তাঁর মনে।

জাপানের সমর্থকেরা এমন হার কল্পনাও করেননি। কিন্তু সেটাই বাস্তবে পরিণত হওয়ায় বান ডাকল অশ্রুর। কাঁদছে জাপান। ছবি: এএফপি
জাপানের সমর্থকেরা এমন হার কল্পনাও করেননি। কিন্তু সেটাই বাস্তবে পরিণত হওয়ায় বান ডাকল অশ্রুর। কাঁদছে জাপান। ছবি: এএফপি

এই তাড়নাটা ছিল গোটা বেলজিয়াম দলের মধ্যেই। আর তাই ৫ মিনিট পরই সমতাসূচক গোল পেয়ে যায় বেলজিয়াম। ডান প্রান্ত থেকে উড়ে আসা ক্রসে হেড করে গোল করেন ফেলাইনি। নাটকীয়ভাবে বেলজিয়ামের এই সমতায় ফেরার পেছনে কোচ মার্তিনেজের ‘মাস্টার স্ট্রোক’-এর প্রশংসা করতেই হয়। ম্যাচের ৬৫ মিনিটে কারাসকোকে তুলে শাদলি আর মের্টেনসের জায়গায় ফেলাইনিকে মাঠে নামিয়েছিলেন মার্তিনেজ। এই দুই বদলি খেলোয়াড়ই গোল করেছেন। আর তাতে বিশ্বকাপ নকআউট পর্বের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে দুই বদলি খেলোয়াড়ের গোল করার রেকর্ডটা এখন বেলজিয়ামের।

ভীষণ রোমাঞ্চকর এই ম্যাচে দুই দলই কতটা মরিয়া হয়ে খেলেছে, তার প্রমাণ পরিসংখ্যান। জাপান (১১) ও বেলজিয়াম (২৪) মিলে গোটা ম্যাচে ৩৫টি শট নিয়েছে। এই বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর কোনো ম্যাচে আপাতত এটাই সর্বোচ্চসংখ্যক শট নেওয়ার নজির।

আগের ম্যাচের একাদশে একটি-দুটি নয়, দশ-দশটি পরিবর্তন এনেছিলেন বেলজিয়াম কোচ রবার্তো মার্তিনেজ। রোমেলু লুকাকু, এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইনারা ফিরেছেন একাদশে। জাপানের একাদশে ছয়টি পরিবর্তন এনেছিলেন কোচ আকিরা নিশিনো। শেষ ষোলোয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে হারলেও মাথা উঁচু করেই বাড়ি ফিরবেন তাঁর শিষ্যরা। আর মার্তিনেজের শিষ্যরা? তাঁরা যে এবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই বিশ্বকাপে এসেছেন, সেই প্রমাণ তো দ্বিতীয়ার্ধের খেলায়, হারের আগে হার না মানার মানসিকতাই ম্যাচটা জিতিয়েছে বেলজিয়ামকে। এবার শেষ আটে তাদের সামনে আরও কঠিন প্রতিপক্ষ—ব্রাজিল!