বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ?

রোস্তভে লাল-নীল রঙের মিশেলে উথালপাতাল ঢেউয়ের সমুদ্রটি শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছে আক্রমণ প্রতি–আক্রমণের সুনামিতে। ছবিতে দুই দলের খেলোয়াড়দের দেখে অন্তত তা–ই মনে হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
রোস্তভে লাল-নীল রঙের মিশেলে উথালপাতাল ঢেউয়ের সমুদ্রটি শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছে আক্রমণ প্রতি–আক্রমণের সুনামিতে। ছবিতে দুই দলের খেলোয়াড়দের দেখে অন্তত তা–ই মনে হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
>বিরতির পর পাল্টে গেল ম্যাচের চিত্র। কেমন সেই চিত্র? আগুনে গতি আর বর্শার ফলার মতো সব আক্রমণ। এক–দুবার নয়, মুহুর্মুহু আক্রমণ। গ্যালারিতে উত্তেজনায় থরহরি কম্পমান দর্শক

দ্বিতীয়ার্ধের তুলনায় প্রথমার্ধের লড়াই কেমন ছিল—‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’? না, প্রথমার্ধে দুই দল যে একেবারে পানসে খেলেছে তা নয়। আক্রমণের বদলা নিতে প্রতি–আক্রমণ হয়েছে, পাসের জবাবে পাস। ডিফেন্সচেরা দৌড়। উইংয়ে আগুনে গতির ঝলকানি। কিন্তু এই অর্ধে কোনো গোল হয়নি। তাই এই অর্ধের খেলা যেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’! অনেকটা রক্ষণ ঠিক রেখে কৌশলে কার্যোদ্ধারের মতলব।

বিরতির পর পাল্টে গেল ম্যাচের চিত্র। কেমন সেই চিত্র? আগুনে গতি আর বর্শার ফলার মতো সব আক্রমণ। এক–দুবার নয়, মুহুর্মুহু আক্রমণ। গ্যালারিতে উত্তেজনায় থরহরি কম্পমান দর্শক। বেলজিয়াম জাপানের রক্ষণে এই ঝাঁপিয়ে পড়ে তো জাপান তাদের রক্ষণে ঢুকে জবাব দিয়ে আসছে। গোটা পঁয়ত্রিশেক শট নিয়েছে দুই দল। এই বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে যা রেকর্ড। পয়সা উশুল ম্যাচ হতে এতটুকুই তো যথেষ্ট! ওহ্, ভুল হলো। শেষ অর্ধে পাঁচটা গোলও হয়েছে। তাহলে কি এই বিশ্বকাপে এটা সেরা ম্যাচ?

নিখুঁত জবাব দেওয়া কঠিন। কিন্তু এতটুকু বলাই যায়, এ রকম গতিময় ম্যাচ এই বিশ্বকাপে দেখা গেছে কি না সন্দেহ! রোস্তভে লাল-নীল রঙের মিশেলে উথালপাতাল ঢেউয়ের সমুদ্রটি শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছে আক্রমণ প্রতি–আক্রমণের সুনামিতে।

একটা পরিসংখ্যান টানা যায়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে এবারই প্রথম নকআউট পর্বের দুটি ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে ৫টি করে গোল দেখা গেল। আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ম্যাচে তা দেখা গেছে প্রথম। সেই ম্যাচে শেষ দিকের সময়টুকু ছাড়া আর্জেন্টিনা কতটুকু লড়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু এই ম্যাচে বেলজিয়াম শুধু জিতেছে, আসলে দুই দলই লড়েছে সমানে সমান। শুরুর মিনিট দশেকে জাপান বার কয়েক হানা দিয়েছে বেলজিয়ামের রক্ষণে। ইউরোপের দলটিও ছেড়ে কথা বলেনি। গোল হতে হতেও হচ্ছিল না—যেন শুধুই ‘ব্লাঙ্ক ফায়ার’।

ভিনসেন্ট কোম্পানি ফ্লাইং কিক মারছেন! না, এমন কিছু ঘটেনি। জাপানের গোলরক্ষকও লাথি থেকে বাঁচতে নয়, বরং বল আটকানোতেই তাঁর মনোযোগ। ছবি: রয়টার্স
ভিনসেন্ট কোম্পানি ফ্লাইং কিক মারছেন! না, এমন কিছু ঘটেনি। জাপানের গোলরক্ষকও লাথি থেকে বাঁচতে নয়, বরং বল আটকানোতেই তাঁর মনোযোগ। ছবি: রয়টার্স

বিরতির পর আর ‘ব্লাঙ্ক ফায়ার’ নয় সাক্ষাৎ গোলাগুলি (পড়ুন গোলগুলি)। ড্রেসিংরুমে দুই দলের কোচ শিষ্যদের কানে কী মন্ত্র পড়ে মাঠে পাঠিয়েছিলেন কে জানে! ফেরারি আর ল্যাম্বরঘিনির মতো ছুটেছেন দুই দলের খেলোয়াড়েরা। ফলাফল, ৪৮ থেকে ৭৪—এই ২৬ মিনিটের মধ্যে চার গোল। এই সময়ের মধ্যে ৪৮ থেকে ৫২—এই ৫ মিনিটের মধ্যে জাপান করেছে জোড়া গোল।

বেলজিয়াম তার জবাবে এক মিনিট সময় বেশি নিয়েছে। ৬৯ থেকে ৭৪—এই ৬ মিনিটের মধ্যে প্রতিপক্ষের পাঠানো জোড়া ফলার কুশলজ্ঞাপনের জবাব দিয়েছেন লুকাকুরা। আর একেবারে অন্তিম মুহূর্তে যখন মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি, তখন বেলজিয়ামের নাসির শাদলি জাপানের বুকে চালিয়েছেন ছুরি! সেই আঘাতে রক্তাক্ত জাপান বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলেও লিখে গেছে নতুন ইতিহাস।

বিশ্বকাপে তারা এর আগে দুবার শেষ ষোলোর নকআউট পর্বে উঠেও গোল পায়নি। এবার সেই খরা ঘোচানোর মধ্য দিয়ে জাপান প্রমাণ করেছে, এই ম্যাচে তারা নিজেদের কতটুকু নিংড়ে দিয়েছিল। কতটুকু আত্মনিবেদন থাকলে ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে ৬১তম হয়েও সেই একই র‍্যাঙ্কিংয়ে তৃতীয় দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করা যায়, জাপান তা বুঝিয়ে গেল। আর বেলজিয়াম?

যুদ্ধ শেষ। চলো, বন্ধু হই। বেলজিয়ামের হ্যাজার্ড কি সেই মন্ত্রই শোনাচ্ছেন? ছবি: রয়টার্স
যুদ্ধ শেষ। চলো, বন্ধু হই। বেলজিয়ামের হ্যাজার্ড কি সেই মন্ত্রই শোনাচ্ছেন? ছবি: রয়টার্স

বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে ন্যূনতম দুই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে জয়ের সর্বশেষ নজির ছিল ১৯৭০ টুর্নামেন্টে পশ্চিম জার্মানি-ইংল্যান্ড ম্যাচে। তারপর বহু দলই একইভাবে পিছিয়ে পড়ে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু বেলজিয়ামের এই দলটার চোখে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন। লুকাকুরা সেই স্বপ্নের পিছু ছুটছেন বলেই তো এই প্রায় ‘অসম্ভব’ কাজটি সম্ভব হলো—হ্যাঁ, ৪৮ বছর আগের সেই ম্যাচের পর বেলজিয়াম দুই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েও জয়ের দ্বিতীয় কীর্তি গড়ল। সেই কীর্তিতে ম্যাচের আগুনে ছবিটা কি ঢাকা পড়ল?

নাহ্‌, রোস্তভের লাল গ্যালারিতে উত্তেজনামথিত আনন্দাশ্রু আর নীল গ্যালারিতে বিষাদের মেঘ মিলেমিশে একাকার হওয়াই তার প্রমাণ। অঝোরে কাঁদছিলেন জাপানের এক সমর্থক। তাঁকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বেলজিয়ামের সেই সমর্থকও কেঁদে ফেললেন। এই দুই কান্নার দুই রকম অর্থ, যা একসূত্রে গেঁথেছে এই আগুনে ম্যাচ। নাকি এই বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ?