পাঁচ সেমিফাইনাল বনাম এক - যা বলছে

এক ম্যারাডোনা নামের বিস্ময়ের কাছেই হেরে গিয়েছিল বেলজিয়াম, তাদের একমাত্র সেমিফাইনালে। ফাইল ছবি
এক ম্যারাডোনা নামের বিস্ময়ের কাছেই হেরে গিয়েছিল বেলজিয়াম, তাদের একমাত্র সেমিফাইনালে। ফাইল ছবি
>বিশ্বকাপে ফ্রান্সের এটি ষষ্ঠ সেমিফাইনাল। বেলজিয়াম এর আগে একবারই সেমিফাইনাল খেলেছে। দুই দলের সেমিফাইনালের গল্প লেখা থাকল এখানে

১৯৫৮ বিপক্ষ ব্রাজিল
সোলনা, সুইডেন
ফল: ২-৫ গোলে হার
প্রথম ৩৭ মিনিট ব্রাজিলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই লড়েছে ফ্রান্স। দ্বিতীয় মিনিটেই গোল পেয়ে যান ব্রাজিলের ভাভা। নবম মিনিটে গোল শোধ করে ফেলেন জাস্ট ফন্টেইন। ৩৭ মিনিটে চোট পেয়ে ফ্রান্সের অধিনায়ক রবার্ত জঙ্কে উঠে যেতেই খেল খতম। ২ মিনিটের মধ্যে দিদির গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধে ফরাসি রক্ষণভাগকে ছিঁড়েখুঁড়ে হ্যাটট্রিক ১৭ বছর বয়সী পেলের। শেষে একটি সান্ত্বনার গোল পায় ফ্রান্স।

১৯৮২ বিপক্ষ পশ্চিম জার্মানি
সেভিয়া, স্পেন
ফল: ৩-৩ ড্র ম্যাচে টাইব্রেকারে ৪-৫ গোলে হার
নির্ধারিত সময়ে ১-১ ড্র। অতিরিক্ত সময়ের ৮ মিনিটের মধ্যে ফ্রান্স এগিয়ে ৩-১ গোলে। ১০২ থেকে ১০৮-এই ৬ মিনিটের মধ্যে দুই গোল করে সমতায় জার্মানি। জার্মান মেশিনের সঙ্গে টাইব্রেকারে আর পেরে উঠল না ফরাসিরা। তবে রোমাঞ্চকর এই ম্যাচটি কুখ্যাত হয়ে আছে জার্মান গোলরক্ষক হ্যারাল্ড শুমাখারের জঘন্য এক ফাউলের জন্য। ৫৭ মিনিটে ফ্রান্সের বদলি খেলোয়াড় প্যাট্রিক ব্যাটিস্টনকে পেনাল্টি বক্সের বাইরে এমন লাথি মারেন যে দাঁত ও পাঁজরের হাড় ভেঙে যায় তাঁর। শুমাখারকে লাল কার্ড দেখানো দূরের কথা, রেফারি ফাউলের বাঁশিও বাজাননি।

১৯৮৬ বিপক্ষ পশ্চিম জার্মানি
গুয়াদালহারা, মেক্সিকো
ফল: ০-২ গোলে হার
আরেকটি সেমিফাইনাল, আরেকবার মুখোমুখি ব্যাটিস্টন-শুমাখার। এবং আরেকবার শেষ চারেই উবে গেল ফরাসি সৌরভ। আগেরবারের মতো এবার আর কোনো অঘটন হয়নি। হাতে হাত মিলিয়েই ম্যাচটি শুরু করেন ব্যাটিস্টন-শুমাখার। ফ্রান্সের হারে বড় দায় গোলরক্ষক জোয়েল ব্যাটসের। ৯ মিনিটে আন্দ্রেস ব্রেমার ফ্রি-কিকটি তাঁর বুকের নিচ দিয়ে চলে যায় জালে। ৮৯ মিনিটে আগুয়ান ব্যাটসের মাথার ওপর দিয়ে বল নিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় গোলটি করেন রুডি ফোলার।

২০০৬ বিশ্বকাপে সর্বশেষ সেমিফাইনাল খেলেছিল ফ্রান্স। ফাইল ছবি
২০০৬ বিশ্বকাপে সর্বশেষ সেমিফাইনাল খেলেছিল ফ্রান্স। ফাইল ছবি

১৯৯৮ বিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া
প্যারিস, ফ্রান্স
ফল: ২-১ গোলে জয়ী
অবশেষে সেমিফাইনালের গেরো কাটল ফ্রান্সের। নিজের দেশের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ফ্রান্স ফাইনালে উঠল রাইটব্যাক লিলিয়াম থুরামের ২ গোলে। ১৪২ ম্যাচের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এর আগে-পরে আর কখনোই গোল পাননি থুরাম। ৪৬ মিনিটে ম্যাচের প্রথম গোলটি করেছিলেন ক্রোয়েশিয়ার ডেভর সুকার। ১ মিনিট পরেই তা শোধ করে দেন থুরাম। ৭৬ মিনিটে লরাঁ ব্লাঁর লাল কার্ডের কথাও বলতে হয়। এতে যে ফাইনালটাই খেলা হয়নি ব্লাঁর।

২০০৬ বিপক্ষ পর্তুগাল
মিউনিখ, জার্মানি
ফল: ১-০ গোলে জয়ী
পেনাল্টি বক্সে থিয়েরি অঁরিকে ফেলে দিয়েছিলেন কারভালহো। পেনাল্টির বাঁশি বাজালেন রেফারি, যা থেকে গোল করতে ভুল করেননি জিনেদিন জিদান। ৩৩ মিনিটের ওই গোলটাই শেষ পর্যন্ত ধরে রাখল ফ্রান্স। আট বছর পর উঠে গেল আরেকটি ফাইনালে।

বেলজিয়াম
১৯৮৬ বিপক্ষ আর্জেন্টিনা মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো
ফল:
০-২ গোলে হার
বিশ্বকাপে এর আগে একবারই সেমিফাইনাল খেলেছে বেলজিয়াম। সেই সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হেরেছে না বলে বলা ভালো হেরেছে ডিয়েগো ম্যারাডোনার কাছে। একটা প্রতিশোধও তাতে নেওয়া হয়েছে ম্যারাডোনার। চার বছর আগে ন্যু ক্যাম্পের সেই রাতটা তিনি কীভাবে ভোলেন! আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির জন্য এমনিতেও ১৯৮২ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচটাকে ভোলা সম্ভব ছিল না। বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেই ম্যাচেই যে তাঁর বিশ্বকাপ-অভিষেক। আর সেই ম্যাচেই কিনা আগেরবারের চ্যাম্পিয়নদের ১-০ গোলে হারিয়ে দিল বেলজিয়াম!
‘প্রতিশোধ’ শব্দটা আসছে এ কারণেই। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মেক্সিকো সিটির অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বলতে গেলে ম্যারাডোনা একাই উড়িয়ে দিলেন বেলজিয়ামকে। সেটি এনজো শিফো-ইয়ান কুলেমান্স-এরিক গেরেটসদের নিয়ে গড়া বেলজিয়ামের প্রথম সোনালি প্রজন্ম। যাঁদের অসহায় চোখে দেখতে হলো ম্যারাডোনা নামের এক ঝড় কেমন এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিচ্ছে তাঁদের স্বপ্নের বাতি।
ঠিক আগের ম্যাচে কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত দুটি গোল ম্যারাডোনার। ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়ে করা প্রথম গোলের পর ইংল্যান্ডের পাঁচজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বিখ্যাত সেই গোল। অবিশ্বাস্য সেই গোলের ধারাবাহিকতাটা যেন সেমিফাইনালেও বয়ে নিয়ে এলেন ম্যারাডোনা।
ম্যাচে বেলজিয়ানদের যত সুখস্মৃতি, তার সবই প্রথমার্ধের। তাঁদের ফরোয়ার্ডরা বসে ছিলেন নিষ্কর্মা হয়ে। তবে আলসেমির সুযোগ ছিল না বেলজিয়ান ডিফেন্ডারদের। ম্যারাডোনা, বুরুচাগা, ভালদানোদের সামলাতেই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। প্রথমার্ধে কাজটা ভালোই করেছেন তাঁরা, প্রথম ৪৫ মিনিটে আর্জেন্টিনা যে কোনো গোল করতে পারেনি।
ম্যারাডোনা ভাবলেন, এখন কিছু করতে হয়। করলেনও। অসাধারণ দুই গোল। ৫১ মিনিটে বেলজিয়ামের পেনাল্টি বক্সে বুরুচাগার থ্রু ধরে গায়ে লেপটে থাকা প্রতিপক্ষ দুই ডিফেন্ডারকে দর্শক বানিয়ে বাঁ পায়ে দারুণ এক টোকায় প্রথম গোল।
আট মিনিট পর আরেকটি অসাধারণ মুহূর্ত, ম্যারাডোনার আরেকটি অসাধারণ গোল। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের অসাধারণ প্রদর্শনীতে চার-চারজন বেলজিয়ান ডিফেন্ডারকে দর্শক বানিয়ে পেয়ে গেলেন দ্বিতীয় গোল।
পরের আধা ঘণ্টায় আর গোলটোল হলো না। আর্জেন্টিনা জিতল ২-০ গোলেই। পরে তো জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপই জিতল দলটি। অন্যদিকে তৃতীয় হওয়ার সান্ত্বনাও জোটেনি বেলজিয়ামের, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ফ্রান্সের কাছে হেরে যায় ২-৪ গোলে।