মেসিকে হারিয়ে জীবন বাঁচালেন যিনি

২০১৫ ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে লিরা। ছবি: এএফপি
২০১৫ ফিফা ব্যালন ডি’অর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে লিরা। ছবি: এএফপি
>

২০১৫ সালে ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন ব্রাজিলের ওয়েন্ডেল লিরা। বছরের সবচেয়ে সুন্দর গোলের এই পুরস্কার বাঁচিয়েছে তাঁর জীবন ও ক্যারিয়ার।

গার্ডিয়ান পুরস্কারটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জিতেছেন। জিতেছেন নেইমার আর হামেস রদ্রিগেজও। কিন্তু তাঁদের কাছে এটা হয়তো আরও একটা ট্রফিমাত্র। ব্যালন ডি’অর, ইউরো, লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগের অনেক ট্রফির ভিড়ে পুসকাস অ্যাওয়ার্ডের ট্রফিটা কেবিনেটের কোথায় আছে, সেটাই হয়তো জানেন না রোনালদো। নেইমার আর রদ্রিগেজের জন্যও এটা খুব বড় কিছু হওয়ার কথা না। কিন্তু একজন আছেন, যাঁর কাছে এই পুসকাস ট্রফিটা মহামূল্যবান। হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তি ফেরেঙ্ক পুসকাসের নামে চালু করা ফিফার সবচেয়ে সুন্দর গোলের এই পুরস্কারটা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছে, বাঁচিয়েছে ক্যারিয়ারও। সেই একজনের নাম ওয়েন্ডেল লিরা।

সাবেক ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার লিরা পুসকাস পুরস্কার জিতেছিলেন ২০১৫ সালে সবচেয়ে সুন্দর গোলের জন্য। ওই বছর ১১ মার্চ ব্রাজিলের গোইয়াস স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপে বৃষ্টিভেজা মাঠে অ্যাটলেটিকো গোইয়ানেন্সের বিপক্ষে দুর্দান্ত ‘স্পিনিং বাইসাইকেল কিকে’ গোলটা করেছিলেন গোইয়ানেশিয়ার হয়ে। সেদিন মাঠে ছিল মাত্র ২৯৭ জন দর্শক। তবু সে গোলটি সবার কাছে ছড়িয়ে পড়ে মাঠে থাকা এক দর্শকের করা ভিডিও থেকে। ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিওর সৌজন্যেই ফিফার বর্ষসেরা গোলের মনোনয়ন পান লিরা।

অথচ কী করুণ এক জীবনই না কাটাতেন লিরা! ব্রাজিলের শীর্ষ পর্যায়ের মাত্র ৬০টি ক্লাবের বছরজুড়ে ম্যাচ থাকে, শুধু ওই ক্লাবগুলোই খেলোয়াড়দের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে। কিন্তু লিরা তখন যে ক্লাবে খেলেন সেই গোইয়ানেশিয়া একেবারে নিচু স্তরের ক্লাব। যেখানে ছয় মাস খেলোয়াড়দের কোনো কাজ থাকে না। বাকি ছয় মাস তাঁরা মাসে বেতন পান ২৫০ ডলার বা এর চেয়েও কম। ওয়েন্ডেল লিরাকে ওই টাকা দিয়েই সংসার চালাতে হতো। ঘরে স্ত্রী ও নবাগত কন্যাসন্তান। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে থাকা লিরা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সিদ্ধান্ত নিলেন আত্মহত্যা করার। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েও পড়িয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, ভয়ংকর গতিতে হাইওয়েতে চালাবেন। একটা বিশাল ট্রাক পেলে সেটার সঙ্গে লাগিয়ে দেবেন। ওই দিনটার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে পরে লিরা বলেছেন, ‘আমার এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। বাচ্চার জন্য দুধ কেনার টাকাও ছিল না আমার কাছে। আমি বেকার ঘুরছিলাম, আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। পরে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।’

সেদিন শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ‘সাহস’ করে উঠতে পারেননি লিরা। ভাগ্যিস, দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পরে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। এর দুই দিন পরেই শুনলেন, ফিফার বর্ষসেরা গোলের সেরা ১০-এ মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। ওই দিনটার কথা মনে করে লিরা বলেছেন, ‘ওই খবরটা যে আমার জীবন কীভাবে বদলে দিল! মনোনয়ন পাওয়ার খবরটা যেদিন জানলাম, আমার একটা সময় ফোন বন্ধ করে দিতে হলো। এত এত ফোন আসছিল। আমি সবার ফোন ধরতে পারছিলাম না।’

সেদিনই একটা পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ফোন করে জানাল, তারা জুরিখে পুরস্কার বিতরণীতে যাওয়া-আসাসহ লিরাকে সপরিবার বিলাসবহুল স্যুটে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। লিরা সেই প্রস্তাবটা গ্রহণ করলেন। জুরিখে গিয়েই তাঁর পরিচয় হলো লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, মার্সেলো, লুকা মদরিচদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত লিওনেল মেসি ও আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জিকে পেছনে ফেলে পুসকাস ট্রফিও জিতে নেন। জুরিখেই আরও একটা ঘটনা ঘটল। যেটা তাঁর জীবনকে বদলে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

শখের বশে লিরা ভিডিও গেমস খেলতেন আগে থেকেই। ফিফা ভিডিও গেমটা খেলা তো তাঁর নেশার মতো ছিল। তো ফিফা পুরস্কারে সেদিন জুরিখে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ফিফা গেমের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আবদুল আজিজ আলশেহরি। তাঁর সঙ্গে নেইমার, মেসি বা রোনালদোর একটা ম্যাচ খেলার কথা ছিল। কিন্তু তিন মহাতারকাই সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটা দেওয়া হয় লিরাকে। লিরা রাজি হলেন এবং ফিফা গেমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আবদুল আজিজ আলশেহরিকে হারিয়ে দেন ৬-১ গোলে! সেদিনই লিরা সিদ্ধান্ত নিলেন ফুটবল ছেড়ে পাকাপাকিভাবে গেমার হয়ে যাওয়ার। পাশাপাশি নিজের একটা ইউটিউব চ্যানেলও খুললেন। যেখানে তিনি শেখান কীভাবে ফিফা গেম আরও ভালো খেলা যায়।

গেমার ও ইউটিউবার হিসেবে তরতরিয়ে এগিয়ে চলল তাঁর ক্যারিয়ার। বদলে গেলে জীবনটাও। বেশ নামডাক হওয়ার কারণেই ব্রাজিলিয়ান একটি রেডিও বিশ্বকাপে তাঁকে ধারাভাষ্যকার হিসেবে চুক্তি করেছিল। তবে বিশ্বকাপ কাভার করতে প্রথম দিন মস্কো বিমানবন্দরে নেমেই ভিসাসংক্রান্ত এক ঝামেলায় পড়ে গেলেন লিরা। একে তো তিনি ইংরেজি বা রুশ ভাষা জানেন না। ওদিকে আশপাশের কেউও রাজি হলেন না তাঁর সমস্যাটা শুনে তাঁকে সাহায্য করতে। ঠিক ওই মুহূর্তেই ফুটবলপ্রেমী এক রুশ অভিবাসন কর্মকর্তা তাঁকে দেখে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ‘পুসকাস, পুসকাস!’ লিরাও উত্তরে হাসলেন, ‘ইয়েস, পুসকাস, পুসকাস।’

পুসকাস পুরস্কার জেতা লিরাকে চিনতে পারলেন অভিবাসন কর্মকর্তা। ব্যস, তাতেই সহজ হয়ে গেল অনেক কিছু। রাশিয়ায় প্রবেশের অনুমতি পেয়ে গেলেন। পুসকাস ট্রফিটা আরও একবার উদ্ধারকর্তা হয়ে এল লিরার জীবনে!