সাব্বিরদের ব্যাট হাতুড়ি হয়ে উঠবে কবে?

হেডকোচ স্টিভ রোডসের সঙ্গে সাব্বির ও মোসাদ্দেক। এই দুই তরুণের কাছ থেকে সবাই ভালো খেলাই দেখতে চান। ছবি: এএফপি
হেডকোচ স্টিভ রোডসের সঙ্গে সাব্বির ও মোসাদ্দেক। এই দুই তরুণের কাছ থেকে সবাই ভালো খেলাই দেখতে চান। ছবি: এএফপি
বাংলাদেশ দলের জয়ে কিংবা ভালো পারফরম্যান্সে ঘুরে ফিরে সেই পাঁচ সিনিয়র খেলোয়াড়ের নামই উঠে আসছে। অথচ দলে রয়েছে কিছু তরুণ ক্রিকেটার। তাদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা আলো ছড়িয়ে হলেও হালে তারা কেন যেন ম্রিয়মাণ। অথচ দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণদের ভালো খেলার যে বিতর্ক নেই


‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’


রবিঠাকুরের ‘সবুজের অভিযান’ কবিতার চরণ। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে সমর্থকদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে পঙ্‌ক্তিগুলো বেশ মিলে যায়। শুধু একটি শব্দ বাদে—‘আধমরা’। বাংলাদেশ দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররা মোটেও আধমরা নয়, বরং দলে তারুণ্যের বোঝা বহন করতে করতে তাঁরা কিছুটা ক্লান্ত। এই ‘ক্লান্ত’ অর্থে অবশ্য আধমরা শব্দটি মানানসই। কিন্তু পারফরম্যান্সের ‘ঘা’ মেরে দলের তরুণেরা সিনিয়র ক্রিকেটারদের একটু নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ দিতে পারছে কই!

ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজের এখনো এক ম্যাচ বাকি। ১-১ ব্যবধানে দুই দল সমতায় থাকায় তৃতীয় ম্যাচটা হয়ে উঠেছে তাই সিরিজ মীমাংসার লড়াই। এ ম্যাচে জেসন হোল্ডারের দল যে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ঝাঁপিয়ে পড়বে মাশরাফি বিন মুর্তজার দলও। সাদা চোখে কল্পিত দৃশ্যটা এমনই। কিন্তু আগের দুটি ম্যাচের স্কোরকার্ড বিবেচনায় এই দৃশ্যে কিছুটা খাদ থেকে যায়। সেই ‘খাদ’ তৈরি করেছেন দলের তরুণ ক্রিকেটাররা। সাব্বির-মোসাদ্দেকদের পারফরম্যান্স কোথায়?

প্রশ্ন এখন সবার। প্রমাণ চাই? প্রথম ওয়ানডেতে ৪ উইকেটে ২৭৯ রান তুলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২৫৭ রান এসেছে দলের তিন সিনিয়রের ব্যাট থেকে—তামিম ১৩০, সাকিব ৯৭ আর মুশফিক ৩০। ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাওয়া দুই তরুণ এনামুল হক আর সাব্বিরের সম্মিলিত অবদান ৭ বলে ৩। দীর্ঘদিন পর দলে ফেরা এনামুল রানের খাতাই খুলতে পারেননি। আর সাব্বির তো বরাবরের মতো আশা জাগিয়ে ব্যর্থ।

কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রমাণ মিলেছে দ্বিতীয় ম্যাচে। বাংলাদেশ জয় থেকে ২৮ বলে ৩৯ রানের দূরত্বে থাকতে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন সাব্বির। অতিক্রম্য এই দূরত্বটা ঘোচানোর দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারবেন—এমন প্রত্যাশাই ছিল। তাঁর জন্যও ব্যাপারটা ছিল বড় সুযোগ। অন্তত নিজেকে ফেরানোর সুযোগ। কিন্তু সাব্বির পারেননি। আন্তর্জাতিক ময়দানে চার বছরের অভিজ্ঞতায় সাব্বির যে শট খেলে আউট হয়েছেন, তা মেনে নিতে হলে অসীম ধৈর্য লাগে। বাংলাদেশের সমর্থকদের সেই ধৈর্যটুকু আছে বলেই পরের ম্যাচে দলে অনেকেই দেখছেন সাব্বিরকে।

সাব্বিরের সঙ্গে তখন উইকেটে ছিলেন মুশফিক। ৭ বলে দরকার ৮ রান। এ অবস্থায় অফ স্ট্যাম্পের বাইরের ফুলটস বলটা সাব্বির কেন জোর করে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে জোর করে খেলতে গেলেন, সেই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
জবাব নেই ওয়ানডেতে সাব্বিরের ধারাবাহিক ব্যাটিং ব্যর্থতার। এই সংস্করণে তাঁর সর্বশেষ ফিফটি গত বছর ডাবলিনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এরপর টানা ১৩ ইনিংসে ন্যূনতম একটি ফিফটিও নেই! সব সংস্করণ মিলিয়ে সর্বশেষ ৩০ ইনিংসে তাঁর ফিফটি মাত্র তিনটি, শূন্য রানে আউট হয়েছেন মোট পাঁচবার।

মোসাদ্দেক প্রথম ম্যাচে বোলিংটা মোটামুটি ভালোই বোলিং করেছিলেন। ৭ ওভারে রান দিয়েছিলেন ২২, কোনো উইকেট পাননি। কিন্তু সাব্বির যেহেতু শুধুই ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন তাই এই পারফরম্যান্সের পরও তৃতীয় ওয়ানডেতে তাঁকে যাঁরা দলে দেখছেন, তাঁরা সত্যিই ধৈর্যের অবতার! মোসাদ্দেকও ভালোই ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। শেষ ম্যাচে যখন উইকেটে এলেন ৫ বলে দরকার ৮ রান। এ অবস্থায় প্রথম দুই বলে তিনি কোনো রানই নিতে পারেননি! অথচ ঘরোয়া ক্রিকেটে এ ধরনের পরিস্থিতিতে হাত পাকিয়েই তিনি উঠে এসেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

ওয়ানডেতে দুই বছর আগে অভিষিক্ত মোসাদ্দেকের অভিজ্ঞতা ২০ ম্যাচের। মাঝে আসা-যাওয়ার মধ্যেও থাকতে হয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে এ সংস্করণে তাঁর সর্বশেষ ফিফটি দুই বছর আগে ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এরপর ১০ ইনিংসে কোনো ফিফটি নেই। সব সংস্করণ মিলিয়ে মোসাদ্দেকের সর্বশেষ ফিফটি গত বছর কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টে। এরপর ফিফটিশূন্য কেটেছে ১৫ ইনিংস। টেস্ট (২), ওয়ানডে (২০) আর টি-টোয়েন্টি (৮) মিলিয়ে ৩০ ম্যাচে তাঁর ফিফটি মাত্র দুটি!

এনামুলের কথাও না বললেই নয়। সাব্বির-মোসাদ্দেকের অনেক আগে তাঁর গায়ে উঠেছে (২০১২) বাংলাদেশ দলের জার্সি। চোট ও বাজে পারফরম্যান্সের জন্য ২০১৫ সালের মার্চের পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ওয়ানডে দলে ফিরেছিলেন এ বছর। এ বছর এই ওপেনার যে ছয়টি ইনিংস খেলেছেন, সেগুলোকে পরপর বসালে এমন দেখায়—১৯, ৩৫, ১, ০, ০, ২৩।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেই আলোচিত হয় বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটাররা দারুণ ‘এক্সাইটিং’। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উত্তেজনা ছড়িয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়তেও তাঁরা সিদ্ধহস্ত (!)। আর তাই বাংলাদেশের জয়ে কিংবা ভালো পারফরম্যান্সে ঘুরে ফিরে সেই ‘ফ্যাব ফাইভ’ (তামিম, সাকিব, মুশফিক,মাশরাফি ও মাহমুদউল্লাহ)-এর নামই উঠে আসে। মাঝে এই প্রথা ভাঙার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। কিন্তু সেই ‘ইঙ্গিত’ আজও নিশ্চয়তায় পরিণত হয়নি।

অথচ আশপাশের দেশের তরুণেরা ‘কাঁচা’ থেকে ‘পাকা’ হয়ে উঠছেন দ্রুতই। পাকিস্তানের কথাই ধরুন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সর্বোচ্চ তিন রান সংগ্রাহক ফখর জামান (৫১৫ রান), ইমাম-উল-হক (৩৯৫ রান) ও বাবর আজম (১৮৪ রান)। প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে হলেও এ সিরিজে তাঁরা যেভাবে রেকর্ডের বন্যা বইয়েছেন সে জন্য কিন্তু মনঃসংযোগ আর ভালো করার ধারাবাহিক খিদের দরকার।

সাব্বির-মোসাদ্দেকদের সেই খিদে চাগিয়ে ওঠা ভীষণ জরুরি। এতে সিনিয়রদের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু তথাকথিত সেই পাঁচ ‘আধমরা’কে ঘা মেরে বাঁচাতে (পড়ুন চাপ কমাতে) সাব্বিরদের ব্যাট হাতুড়ি হয়ে উঠবে কবে?