জীবনের নদীতে সাঁতরেই কুল পাচ্ছেন না সোনাজয়ী সাঁতারু

এসএ গেমসে ২ সোনা জিতে ঢাকায় ফেরা শিলা।  ফাইল ছবি
এসএ গেমসে ২ সোনা জিতে ঢাকায় ফেরা শিলা। ফাইল ছবি
>মায়ের ক্যানসার, ফ্ল্যাট নিয়ে জটিলতা, দল থেকে বাদ-সব মিলিয়ে হতাশায় অবসরের ভাবনা মাহফুজা খাতুন শিলার

‘আগামী এসএ গেমসে আর পানিতে নামব না। শেষবারের মতো হয়তো সাঁতরে এসেছি ভারতে’-মাহফুজা খাতুন শিলা গতকাল মুঠোফোনে বলছিলেন প্রথম আলোকে। কণ্ঠে ক্ষোভ। সেটি থিতিয়ে যেতে না-যেতেই নৌবাহিনীর এই সাঁতারু যোগ করেন, ‘আমার কর্মস্থল যদি অনুমতিটা দিয়ে দেয় তাহলে সাঁতার থেকে ইস্তফা দেব। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।’

দক্ষিণ এশীয় গেমস থেকে বাংলাদেশকে সোনা জেতানো প্রথম নারী সাঁতারু শিলা। এসএ গেমসে সাঁতারে দশ বছরের সোনার খরা ঘুচিয়েছেন তিনি। দুই বছর আগে ভারতে ইতিহাস গড়া সেই শিলা ফেডারেশনের অবহেলায় ‘ক্ষয়ে’ যেতে বসেছেন।

ইন্দোনেশিয়ায় ১৮ আগস্ট শুরু হতে যাওয়া এশিয়ান গেমসের দল থেকে আগেই বাদ দেওয়া হয়েছে তাঁকে। পাঠানো হয়নি গত এপ্রিলে গোল্ডকোস্ট কমনওয়েলথ গেমসেও। ভবিষ্যতে আর কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই তাঁর ঘোর সংশয়। ইনচনে গত এশিয়ান গেমসে সাঁতার থেকে কাউকে পাঠায়নি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ)। এবার ছেলেদের বিভাগে ৫০,১০০ ও ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে অংশ নেবেন মাহফিজুর রহমান সাগর। মেয়েদের ৫০ ও ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে খাদিজা আক্তার। খাদিজার সাফল্য বলতে গত যুব গেমসে ২টি সোনা জয়। গত এসএ গেমসে ৭টি ব্রোঞ্জজয়ী সাগর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরোনো মুখ। কিন্তু খাদিজার জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হতে যাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া এশিয়ান গেমস।

এশিয়াডে বাংলাদেশের সাঁতারুদের পক্ষে পদক জেতাটা কঠিন। নিজেদের সেরা টাইমিং করতে পারলেই তাঁরা খুশি থাকেন। কিন্তু গেমসগুলোয় সেরা সাঁতারুদের কি পাঠাচ্ছে ফেডারেশন? শিলার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে, ‘এশিয়ান গেমসে খাদিজা বয়সে ওর চেয়ে অনেক বড় মেয়েদের সঙ্গে সাঁতরাবে। তাকে যুব অলিম্পিকে পাঠালেই ভালো করত ফেডারেশন। ওর চেয়ে জোনায়নাকে (জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে ১০টি ইভেন্টের ৯ টিতে রেকর্ড গড়ে সোনাজয়ী লন্ডনপ্রবাসী জোনায়না আহমেদ) পাঠালেই ভালো হতো। ওর জন্য একটা বড় প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন। কারণ আগামী এসএ গেমসে জোনায়নার ভালো কিছু করার সম্ভাবনা আছে।’

এসএ গেমসে জোড়া সোনা জয়ের পর শিলা অংশ নিয়েছেন চারটি আন্তর্জাতিক এবং একটি জাতীয় প্রতিযোগিতায়। ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কায় দক্ষিণ এশিয়ান অ্যাকুয়াটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে সময় নেন ৩৫.৩০ সেকেন্ড। এরপর কানাডায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের এই ইভেন্টে শিলা সময় করেন ৩৫.৫৬ সেকেন্ড। ২০১৭ সালে একই ইভেন্টে আজারবাইজান ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে শিলার টাইমিং (৩৪.৮১ সেকেন্ড) ছিল এসএ গেমসে সোনা জয়ের সময়ের চেয়েও ভালো (৩৪.৮৮)। তবে হাঙ্গেরিতে ওই বছর ৫০ মিটারে শিলার টাইমিং ভালো হয়নি (৩৬.২০ সেকেন্ড)। টাইমিংয়ের এমন উত্থান-পতনের পেছনে অনুশীলনের অভাবকেই দায়ী করেন শিলা, ‘জাতীয় দলে নিয়মিত ক্যাম্প চলে না। অনুশীলন করতে পারিনি বলে শ্রীলঙ্কায় যেতে চাইনি। জোর করে ফেডারেশন আমাকে পাঠিয়েছিল। হাঙ্গেরি যাওয়ার ১০ দিন আগে শুরু হয় ক্যাম্প। তখন জিও (সরকারি আদেশপত্র) নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করব নাকি সাঁতরাব?’

এমনিতেই গত এক বছর মানসিকভাবে ভীষণ বিধ্বস্ত শিলা। মা করিমুন্নেসা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁকে নিয়ে বিদেশে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। সম্প্রতি যোগ হয়েছে আরেক দুশ্চিন্তা। ভারোত্তোলক মাবিয়া ও শুটার শাকিলের সঙ্গে তিনিও উঠতে পারছেন না সরকারের দেওয়া ফ্ল্যাটে। তাঁদের ফ্ল্যাট প্রস্তুত কিন্তু সরকার থেকে বরাদ্দ করা টাকা না পাওয়ায় ফ্ল্যাট বুঝে দিচ্ছে না রাজউক। সরকারের আশ্বাসে ভাড়া বাসায় উঠলেও ১৬ মাস ধরে সেই ভাড়ার টাকাও পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে সাঁতার নিয়ে হতাশা ঘিরে ধরেছে শিলাকে।

ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোল্লা বদরুল সাইফ প্রকারান্তরে শিলার বিদায়রাগিণীই বাজিয়ে দিলেন, ‘নতুনদের সুযোগ দিতেই শিলাকে এবারের এশিয়াডের জন্য নির্বাচন করা হয়নি। আগামী এসএ গেমসেও ওকে নিয়ে আমাদের আশা নেই।’