আমি কাঁদব কেন?

বাংলাদেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলে ফেললেন মামুনুর রহমান চয়ন। ছবিঃ প্রথম আলো ফাইল ছবি
বাংলাদেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলে ফেললেন মামুনুর রহমান চয়ন। ছবিঃ প্রথম আলো ফাইল ছবি

জাতীয় দলের জার্সিতে গতকাল শেষ ম্যাচ খেলেছেন হকি তারকা মামুনুর রহমান চয়ন। ইন্দোনেশিয়াতে বিদায় বেলায় মাসুদ আলমকে শুনিয়েছেন তাঁর হকি জীবনের পাওয়া না পাওয়ার গল্প।

অবসরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে একজন খেলোয়াড় আবেগাপ্লুত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আশ্চর্য ব্যতিক্রম মামুনুর রহমান চয়ন। মুখে চওড়া হাসি। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলার পর স্বদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন ১২ বছরের আন্তর্জাতিক হকি ক্যারিয়ার নিয়ে। কিন্তু একটিবারও কোনো আক্ষেপ বা মন খারাপ বোঝায়, এমন কিছু বলেননি বাংলাদেশের হকিতে আধুনিক যুগের সেরা পেনাল্টি কর্নার বিশেষজ্ঞ।

জিমি-চয়ন বাংলাদেশের হকির মুখ হয়ে ছিলেন গত এক যুগ। চয়ন অতটা প্রচারের আলোয় ছিলেন না। থাকতেন একটু আড়ালেই। এভাবেই ফরিদপুর শহরে পাড়ার বড় ভাই মুসা মিয়ার চারটি এশিয়ান গেমস খেলার রেকর্ড ছুঁয়ে ফেললেন। গতকাল শেষবারের মতো পরলেন লাল-সবুজ জার্সি। জাকার্তার গ্লোরা বুং কার্নো ক্রীড়া কমপ্লেক্সের হকি মাঠে শেষ বাঁশির পর সবাই ঘিরে ধরলেন তাঁকে।

একদিক থেকে চয়নকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। সতীর্থদের পাশাপাশি গার্ড অব অনার পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড়দেরও। মিক্সড জোনে কথা বলার পর ফেরার পথে প্রথম আলোকে যা বললেন-

প্রথম আলো: এতক্ষণ আপনি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু একটিবারও আপনার চোখ চিকচিক করতে দেখলাম না। আপনি আর দশটা দিনের মতোই হাসিখুশি। এটা কি ওপর দিয়ে দেখাচ্ছেন? নাকি ভেতরে-ভেতরে দহন হচ্ছে?

চয়ন: আমি মন খারাপ করব কেন ভাই, বলেন। আমি কাঁদবই-বা কেন? বিদায়ের দিন কাঁদছি না, আমি তৃপ্ত বলে। আমি আজ এত তৃপ্ত যে আপনি আমার বুকটা খুলে দেখুন। আমার হাহাকার করার কিছু নেই। হকি খেলে আমি সব পেয়েছি।

প্র. আ.: সব পেয়েছেন বলতে আসলে কী কী পেয়েছেন?
চয়ন: এই যে জাতীয় দলে টানা ১২ বছর খেললাম...। ২০০৬ দোহা এশিয়ান গেমসের বাছাই দিয়ে জাতীয় দলে শুরু। সেই থেকে চারটি এশিয়ান গেমস খেলার স্বপ্নটা পূরণ করেছি। আপনারা আমাকে চয়ন বানিয়েছেন। জিমি-চয়নকে মানুষ চেনে, ভালোবাসে। অনেক ট্রফি জিতেছি। খারাপ সময়ও গেছে। তবে আজ বিদায়বেলায় আপনারা, বিদেশিরা, আমার সতীর্থরা যেভাবে শুভেচ্ছা জানাল, এটাও বড় প্রাপ্তি। বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন স্মারক দিল একটি। আমি সত্যিই আনন্দিত।

প্র. আ.: দেড় শর মতো ম্যাচ খেলেছেন। ডিফেন্ডার হয়েও ৬০-৭০টি গোল আছে। আন্তর্জাতিক হকিতে বাংলাদেশের হয়ে আপনারই সবচেয়ে বেশি আটটি হ্যাটট্রিক। তা সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ কোনটি?
চয়ন: ২০১৩ সালে চীনের বিপক্ষে সেই জয়টা। দিল্লিতে বিশ্ব হকি লিগের রাউন্ড টুতে। চীনকে আমরা হারিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার, ওই জয়ের পর জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের ক্যাম্পের জন্য মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে ফেডারেশন হোস্টেল বানায়।

প্র. আ.: ওই টুর্নামেন্টে জিমি সেরা মিডফিল্ডার হয়েছিলেন। আপনিও দারুণ খেলেছিলেন।
চয়ন: হ্যাঁ, ওই ম্যাচটা ভুলি না। ওটা আমাদের প্রেরণা দিয়েছে সামনে এগোতে।

প্র. আ.: বড় প্রশ্নটায় আসি। আপনি তো চাইলে আরও দুই-তিন বছর খেলতে পারতেন...
চয়ন: আরও দুই-তিন বছর খেললে আপনারাই হয়তো আজকের এই সম্মানটা আর দিতেন না। বলতেন, ও যাচ্ছে না কেন? তাই নিজেই চলে গেলাম। তবে আমি আছি তো, ঘরোয়া হকি খেলব। আমার দল নৌবাহিনীকে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন করতে ভূমিকা রাখব।

প্র. আ.: কিন্তু আজ আপনার অবসরটা তো স্মরণীয় হলো না। কোরিয়ার কাছে ৭-০ গোলে হার...
চয়ন: আসলে ওরা এত এগিয়ে যে আমরা চেষ্টা করেও পারিনি। তবে ওপরে আসার চেষ্টা তো আমরা করেছি। দুই-চারবার পেরেছিও। তবে বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে। এটা ঠিক, মনে রাখার মতো হলো না।

প্র. আ.: জাতীয় দলে আপনার শুরু আর শেষটা কেমন? দুই সময়ের যদি একটা তুলনা করেন?
চয়ন: আমরা আসলে বড় দলের সঙ্গে আগে খেলতাম একটাই ধান্দা নিয়ে। বল পেলে ক্লিয়ার করে দেব। এখন সেটি না করে ওপরে উঠি। লড়াই করি। চেষ্টা করি পাল্টা কিছু করতে। জাতীয় দলে এটা বড় পরিবর্তনই।

প্র. আ.: কিন্তু ঘরোয়া হকির অবস্থা অনেক দিন ধরেই খারাপ। নিয়মিত খেলা হয় না। বিদায়বেলায় এটা ভাবলে কেমন লাগে?
চয়ন: খুব খারাপ লাগে। লিগটা নিয়মিত হওয়া দরকার। এটা হয় না দেখে খেলোয়াড় উঠে আসছে না। সবার প্রতি আমার একটাই অনুরোধ, লিগটা নিয়মিত করুন। নইলে হকি বাঁচবে না।

প্র. আ.: বিদায়ের দিনে কাকে বেশি মনে পড়ছে?
চয়ন: আমার তিন বছরের ছেলের মুখটা ভাসছে। ওকে এত দিন সময় দিতে পারিনি বলে আমার মনটা খারাপ থাকত। ভিডিও কল দিলে ভীষণ খারাপ লাগে। এখন সময় দিতেই মূলত অবসর নিলাম জাতীয় দল থেকে। আর মামুনুর রশীদ স্যারের কথা বলব। তিনি আমার বস। বিকেএসপিতে আমাকে পেনাল্টি কর্নার শিখিয়েছেন। পাকিস্তানের পিসি বিশেষজ্ঞ সোহেল আব্বাসকে আদর্শ মেনে বড় হয়েছি। তাঁকেও মনে পড়ে। ফরিদপুরে আমার সব বন্ধু, গুরুদেরও স্মরণ করছি।

প্র. আ.: ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম, শুটার আবদু্ল্লাহ হেল বাকিদের সঙ্গে একই সময়ে বিকেএসপিতে ছিলেন। তাঁরা খেলছেন, আপনি সরে যাচ্ছেন। তা মুশফিকরা কিছু বলেছেন তাঁদের বন্ধুকে?
চয়ন: ফেসবুকে ওরা বলছে, এখনই কেন যাচ্ছি। মুশফিককে আমি বলেছি, ১২ বছর ক্রিকেট খেলা যায়, হকি খেলাটা কঠিন। ফিটনেস ধরে রাখতে প্রচুর পরিশ্রম লাগে।

প্র. আ.: আগামীকাল এশিয়ান গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দলের পতাকা থাকবে আপনার হাতে। হঠাৎই এই সিদ্ধান্ত। কেমন লাগছে?
চয়ন: আমি ভীষণ খুশি। অবশেষে বড় অনুষ্ঠানে দেশের পতাকা হাতে তুলব। রোমাঞ্চকর লাগছে। ধন্যবাদ বিওএকে, বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনকে।

প্র. আ.: ধন্যবাদ তো আপনিও পাবেন। এত বছর দেশের জন্য মাঠে লড়েছেন...
চয়ন: আমি আমার সেরাটা দিতে চেয়েছি সব সময়। জানি না, কতটা কী করতে পেরেছি। তবে আমার কোনো অতৃপ্তি নেই।