ডট বলকে 'নট' বলবে কবে বাংলাদেশ?

জাদেজার স্পিনেই কেঁপেছে বাংলাদেশ। মিঠুন আউট হওয়ার পর। ছবি: এএফপি
জাদেজার স্পিনেই কেঁপেছে বাংলাদেশ। মিঠুন আউট হওয়ার পর। ছবি: এএফপি
>বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা স্পিনে ভালো খেলেন—বহুল প্রচলিত এ কথাটা সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ।

আট ওভারের খেলা শেষ। দুই ওপেনার লিটন ও শান্ত ততক্ষণে ড্রেসিং রুমে। উইকেটে ছিলেন মুশফিকুর রহিমসাকিব আল হাসান। নবম ওভারে যুজবেন্দ্র চাহালকে আক্রমণে নিয়ে এলেন ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা। ধারাভাষ্যকার বুঝিয়ে দিলেন, স্পিনার আসায় এখন কিছুটা স্বস্তি নিয়ে ব্যাটিং করতে পারবে বাংলাদেশ। সহজাতভাবেই তাঁরা স্পিন ভালো খেলে। কথাটা কদিন আগেও হয়তো কানে স্বাভাবিক শোনাত। কিন্তু এখন, অন্তত এশিয়া কাপে বিস্ময়জাগানিয়া।

প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানেরা তো এমনিতেই স্পিন ভালো খেলেন! সেটি অবশ্য এখানকার উইকেট বিচারে। বেশির ভাগ উইকেটই স্পিনবান্ধব। বাংলাদেশও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে প্রতিপক্ষের স্পিনারদের সামনে। পা চলে তো ব্যাট চলে না! বলের ফ্লাইট পড়তে ভুল হচ্ছে। নমনীয় কবজির ব্যবহারে স্ট্রাইক অদল-বদল স্বচ্ছন্দ না হওয়ায় ধৈর্য হারাচ্ছেন ব্যাটসম্যানেরা। ফলে ‘রিভার্স সুইপ’-এর ঝুঁকি নিতে গিয়ে হারাতে হচ্ছে উইকেট।

১৮তম ওভারে মুশফিকের আউট মনে করে দেখুন। রবীন্দ্র জাদেজার সেই ওভারের দ্বিতীয় বলে ২ রান নেওয়ার পর টানা তিন বলে কোনো রান পাননি মুশফিক। এর মধ্যে ওভারের চতুর্থ বলে ‘বিট’ হয়েছেন। পরের বলেও রান পাননি। মুশফিক ‘রিভার্স সুইপ’ ভালো খেলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসই কাল হলো পরের বলে। স্ট্রাইক নিয়মিত অদল-বদল করে খেললে বাংলাদেশের এই দলের সেরা ব্যাটসম্যানটিকে তখন ওই শট খেলার ঝুঁকি নিতে হতো না। কিন্তু স্পিনারদের বিপক্ষে যে সেটি হচ্ছে না। কাল এবং আজকের ম্যাচটা ধরলে পরিস্থিতি নিদারুণ!

কাল বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ‘কঙ্কাল’ বের করে ছেড়েছেন আফগান বোলাররা। তার নেপথ্যে ১৭১ টি ‘ডট’ বলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর মধ্যে দুই আফগান পেসারের বিপক্ষে ‘ডট’সংখ্যা ৪০। বাকি ১৩১টি ‘ডট’ বল স্পিনারদের বিপক্ষে। এর মধ্যে রশিদ খান (৪৪) ও মোহাম্মদ নবী (৪২) মিলেই ৮৬টি ‘ডট’ বল তুলে নিয়েছেন। রশিদ না হয় বিশ্বমানের লেগ স্পিনার কিন্তু নবী? সাদামাটা না হোক দুর্বোধ্য অন্তত নয়। তাঁর বিপক্ষে ৬০ বলের মধ্যে ৪২টি-ই ‘ডট’!

আফগানিস্তানের আরেক উঠতি তারকা স্পিনার মুজিব উর রহমানের ‘ডট’সংখ্যা ৩১। বল করেছেন ৮.১ ওভার মানে ৪৯টি বৈধ ডেলিভারি। মুজিব পাদপ্রদীপের আলোয় আসার পথে থাকলেও তিনি নিশ্চয়ই শেন ওয়ার্ন কিংবা মুত্তিয়া মুরালিধরনদের মতো কেউ নন। সেই যুগে ওয়ার্ন-মুরালিদের হাবিবুল বাশার-আশরাফুলরা যেভাবে সামলেছেন, মুশফিক-সাকিবরা রশিদ-মুজিব কিংবা অন্য দলের স্পিনারদের বিপক্ষে তা কতটুকু সফলতার সঙ্গে পারছেন সেই প্রশ্ন থাকছে।

এক সময় বাঁহাতি স্পিনারের খনি বলা হতো বাংলাদেশকে। এক সঙ্গে তিন বাঁহাতি স্পিনার খেলানোর কাণ্ড দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ আজ জাদেজাতে কুপোকাত। শুধু চারজন ব্যাটসম্যান তাঁর বলে আউট হয়েছেন বলে নয়। তাঁর ৬০টি বৈধ বলের ৪৩টি বলেই কোনো রান নিতে পারেনি বাংলাদেশ। দুই লেগ স্পিনার (চাহাল ও যাদব) মিলেও আদায় করে নিয়েছেন ৭০টি ডট। সব মিলিয়ে আজ ভারতের বোলারদের ২৯৫টি বৈধ ডেলিভারির মধ্যে ১৯১টি ডট।

প্রশ্ন থাকছে স্পিনারদের বিপক্ষে ব্যাটসম্যানদের অ্যাপ্রোচেও। সাকিব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ দলের অন্যতম সেরা স্ট্রোক মেকার। নির্ভরতার জায়গাও। কিন্তু তিনে ব্যাটিং করলে ইনিংস টানতে হয়—সে কথা কি তাঁর মাথায় ছিল? আজ পাঁচ ওভারের মাথায় লিটন আউট হওয়ার পর উইকেটে এসেছেন সাকিব। চাপের মুহূর্তে তিনি দ্রুত ফিরলে ইনিংসে যে মড়ক লাগতে পারে এটা তাঁর মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের জানার কথা। সঙ্গে কালকের ম্যাচে দলের ব্যাটিং অর্ডারের ‘আশ্চর্য পতন’-এর টাটকা স্মৃতি তো রয়েছেই। কিন্তু জাদেজার করা ১০ম ওভারে ওই পরিস্থিতিতে সাকিবের ওই শট খেলার কতটুকু দরকার ছিল, সে প্রশ্নের জবাব কোথায়?

ওই ওভারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডেলিভারি থেকে দুটি চার তুলে নেন সাকিব। এর মধ্যে শেষটা পেয়েছেন অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলকে স্কয়ার লেগ অঞ্চলে সুইপ করে। জাদেজা চতুর্থ ডেলিভারিটি করার আগে মহেন্দ্র সিং ধোনি তাঁকে স্কয়ার লেগ অঞ্চলে ফিল্ডার রাখার টোটকা দেন। সাকিবের সামনেই এসব ঘটেছে। কিন্তু পরের বলেই একইভাবে সুইপ করে সাকিব স্কয়ার লেগে শিখর ধাওয়ানের তালুবন্দী! অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের এই যদি হয় স্পিন খেলার মানসিকতা তাহলে তরুণেরা শিখবে কীভাবে?

তরুণ? এশিয়া কাপ শুরুর আগে মাশরাফি একটা কথা বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন-চার বছর খেলার অভিজ্ঞতা হয়ে গেলে সে তরুণ থাকে কীভাবে? মিঠুনের ওয়ানডে অভিজ্ঞতা ৪ বছরের। ঘরোয়াতে স্পিনারদের ভালো খেলার ব্যাপারেও তাঁর বেশ সুনাম। কিন্তু আজ তা রাখতে পারলেন কোথায়? জাদেজার করা ১৪তম ওভারে একবার লেগ বিফোর থেকে বেঁচে গেছেন। ব্যাটের আগে পা আগে যাওয়ার প্রবণতা থাকায় বলটা তাঁর প্যাডে লেগেছিল আগে। আম্পায়ার সাড়া দেননি আর জাদেজাও রিভিউ নেননি। পরে ভিডিও রিপ্লেতে দেখা গেল, রিভিউ নিলে ওটা আউট। মিঠুন কিন্তু এই ফাঁড়া থেকে শিক্ষা নেননি। পরে আউট হয়েছেন ঠিক একই ডেলিভারিতে, একই বোলারের বিপক্ষে!

একেবারে আনকোরা তরুণ কিংবা অভিজ্ঞদের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন থাকছে। কাল যেমন আফগানিস্তানের বিপক্ষে অভিষিক্ত নাজমুল হোসেন শান্তর আউটটা। মুজিব উর রহমানের বলে মোটেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন না নাজমুল। ধৈর্যহারা হয়ে আউট হয়েছেন দৃষ্টিকটুভাবে—অনেকটাই জোর করে! তুলে মারতে গিয়েছিলেন কিন্তু বলটা ব্যাটের কোথায় লেগেছে সে হদিস ছিল না। শেষ পর্যন্ত তালুবন্দী হয়েছেন পয়েন্টে। কিংবা অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের আউট—রশিদ খান কিংবা মুজিবকে খেলতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। ‘বিট’ হয়েছেন বহুবার, পরে বোল্ড হলেন সোজা ডেলিভারিকে কঠিন করে খেলতে গিয়ে।

স্পিনারদের বিপক্ষে কবজি আর পায়ের ব্যবহারে স্ট্রাইক রোটেট করলেই আর চেপে বসতে পারে না ফিল্ডিং দল। কিন্তু একের পর এক ডট বল দিয়ে নিজেরাই তো চাপটা টেনে নিচ্ছেন কাঁধে। এর প্রভাব পড়ছে ম্যাচের ফলেও। বাংলাদেশ স্পিন ভালো খেলে—সাম্প্রতিক সময়ে কথাটা তাই বিস্ময় জাগাচ্ছে!