এলেন, দেখলেন, জয় করলেন

ভিনি, ভিডি, ভিসি—এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। কে?

ইতিহাস পড়ুয়াদের ঠোঁটের আগায় থাকবে জবাবটা, জুলিয়াস সিজার। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা বলতে পারেন, সে আবার কে? এ তো ইমরুল কায়েস!

কথাটা সিজারের। চার ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে প্রায় বিনা বাধায় পন্টুস রাজ্য দখলের পর রোমের সিনেটকে ওই তিন শব্দে জয়ের খবর জানিয়েছিলেন সিজার। এই ঘটনা খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালের। দুই হাজারেরও বেশি বছর পেরিয়ে প্রবাদে পরিণত হওয়া এই কথাটা মনে করিয়ে দিলেন ইমরুল স্মরণীয় এক ইনিংস খেলে। কাল রাতে বাঁচামরার লড়াইয়ে। যে লড়াইয়ের আগে ইমরুল আরব আমিরাত গিয়েছেন অনেকটা এভাবে—ওঠ, ছুড়ি তোর বিয়ে!

তা নয় তো কী? ওয়ানডে দলে ইমরুল ব্রাত্য হয়ে ছিলেন প্রায় এক বছরেরও বেশি সময়। হুট করে এশিয়া কাপ খেলার পথে তাঁর উড়াল দেওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তামিম ইকবালের চোট এবং বিকল্প ওপেনারদের ক্রমাগত ব্যর্থতায় প্রথা ভাঙতে বাধ্য হয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। নির্বাচকমণ্ডলী কিংবা অধিনায়ককে না জানিয়ে দেশ থেকে ইমরুল আর সৌম্য সরকারকে উড়িয়ে এনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। সেটিও আবার এমনভাবে, দেশ থেকে আগের দিন বিমানে উঠে পরের দিন নেমেই মাঠে! এই ভ্রমণক্লান্তির সঙ্গে বিবেচনায় থাকুক আবুধাবির চল্লিশোর্ধ্ব সেলসিয়াস ডিগ্রির তাপমাত্রা আর চাপের মাত্রা?

পারদ থার্মোমিটারের মাথায় উঠলে যা হয় ঠিক তা-ই। একে তো বাঁচামরার ম্যাচ। টিকে থাকতে হলে জিততেই হবে। প্রতিপক্ষ এমন একটা দল (আফগানিস্তান) যাদের কাছে গ্রুপ পর্বে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে এবং তাদের কাছে হারলে সম্মানে চোট লাগে। কালও সে সম্ভাবনা ছিল। যখন ৮১ রান তুলতেই ৪ উইকেট নেই। ইমরুল এ সময় উইকেট এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।

কী জিতলেন? নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস। সমর্থকদের আস্থা আর নির্বাচকদেরও কি? নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। অন্তত ইমরুলের ক্ষেত্রে কথাটা খাটে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে দুর্ভাগাদের একজন বলে কথা! কোনো সিরিজে গোটা দল খারাপ করেছে। বাদ কে? ইমরুল। টপ অর্ডার ভাঙছে। কাকে বাদ দিতে হবে? হাতের কাছে ইমরুল তো আছেই—যেন উনুনের ছাই ফেলতে ‘ভাঙা কুলো’। অবশ্য তাঁর নিজেরও দায় থাকবে উঠতি-পড়তি ফর্মের জন্য, যা কখনোই স্থির হয়নি দলে তাঁর অবস্থানের মতোই।

কিন্তু কাল ব্যাটিংয়ের পজিশনটা অচেনা হলেও ইমরুল স্থির ছিলেন। তার আগের দিন প্রায় মধ্যরাতে টিম হোটেলে পৌঁছে পরদিন দুপুরে খেলতে নামতে হয়েছে ১৫০ কিলোমিটার দূরের আবুধাবিতে। এসব ক্ষেত্রে বোলারের চেয়ে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই বোধ হয় বড় চ্যালেঞ্জ। ইমরুল এ দুটি চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে জিতেছেন তাঁর ক্যারিয়ারে একেবারেই অচেনা ব্যাটিং পজিশনে—৬ নম্বর!

২০০৮ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর এ পর্যন্ত ৭১ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ইমরুল কালই প্রথম ৬ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন। মাথার ওপর তখন পাহাড়প্রমাণ চাপ। দল বিপর্যয়ে আর এই পরিস্থিতিতে খারাপ করলে ‘ইমরুল কেন আবার দলে?’এমন রব তুলতেও হয়তো দ্বিধা করবেন না দেশের আবেগী ক্রিকেটপ্রেমীরা। এমন কিছু ইমরুলের ক্যারিয়ারে নতুন কিছু না। কিন্তু কাল তাঁর ব্যাট দেখিয়েছে নতুন কিছু—৮৯ বলে অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংস, যা দলের ইনিংসও টেনেছে শেষ পর্যন্ত। এক কথায় ইনিংস-সঞ্জীবনী ব্যাটিং। ৫ উইকেটে ৮৭ রানের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে তাঁর ও মাহমুদউল্লাহর লড়াই শেষ পর্যন্ত গড়েছে দলের লড়াইয়ের ভিত।

অথচ ইমরুলের গায়ে তকমা লেগে গিয়েছিল ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’। এসব তকমা দৈবক্রমে লাগে না। কীভাবে লেগে যায় কিংবা লাগানো হয়। কিন্তু কাল ইমরুলের গা থেকে তকমাটা যেন খসে পড়ল। আগের দুই ম্যাচেই ১৭০টির বেশি ‘ডট’ বল খেলেছে বাংলাদেশ। ব্যাটিং খোলসে ঢুকে পড়ার যা অন্যতম কারণ ছিল। ৮৯ বলের ইনিংসে ইমরুল সেই সমস্যার সমাধান করেছেন এভাবে—৩৭টি সিঙ্গেলস, ৪টি ডাবলস আর ৬টি চার। ‘ডট’সংখ্যা ৪২। এই পরিসংখ্যানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, আগের ম্যাচে ত্রাস ছড়ানো রশিদ খানকে যেভাবে খেলেছেন। এই লেগির গুগলিগুলো যেভাবে পড়ে রান বের করেছেন। ‘সফট হ্যান্ড’-এ খেলে রান বের করার কায়দাটা এই এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানেরা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন!

ইমরুল-মাহমুদউল্লাহর জুটিতে ‘সফট হ্যান্ড’ আর ‘বটম হ্যান্ড’—দুটি কৌশলের ব্যবহারই ছিল সময়োচিত। সতীর্থের ব্যাটিংকে উইকেটের অন্যপ্রান্ত থেকে দেখার অনুভূতিটা মাহমুদউল্লাহ জানালেন এভাবে, ‘আমার কাছে দারুণ লেগেছে। ইমরুল কখনো ছয়ে ব্যাটিং করেনি, টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। প্রথমবার ছয়ে নেমে এমন বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে এত দারুণ খেলা ছিল অসাধারণ কিছু।’

ইমরুলকে অচেনা পজিশনে ঠেলে দেওয়াটাও নাকি ছিল দলের পরিকল্পনার অংশ। মাহমুদউল্লাহ জানালেন, ‘পরিকল্পনা তো ছিলই। ওর অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগানোর পরিকল্পনা ছিল আমাদের। এটাই আমাদের গেমপ্ল্যান ছিল।’

মুহূর্তের মহিমায় কিংবা ‘দৈব’ ইশারায় ইমরুল উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন দলে। প্রতিকূল কন্ডিশন আর অচেনা পজিশনে দাঁড়িয়ে দলকে এনে দিয়েছেন লড়াইয়ের পুঁজি। এমন ক্রিকেটারদের কী বলা যায়? এমনিতে বিশেষণের কোনো অভাব নেই। আর কেউ ভালো কিংবা খারাপ করলে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা এসব বিশেষণের ব্যবহারটাও ভালোই জানেন। এই যে ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’ বলা হচ্ছে, তাতে ইমরুলের বোধ হয় কিছুই যায় আসে না। বাইশ গজে এত দিনের পথচলায় যে তিনি শিখেছেন, পরের ম্যাচেই যে বাদ পড়তে পারেন!