রশিদ খানের বন্ধু খেলবেন বাংলাদেশে?

২৩ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জন্মদিন। সতীর্থদের পক্ষ থেকে তাঁকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। সংগৃহীত ছবি
২৩ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর জন্মদিন। সতীর্থদের পক্ষ থেকে তাঁকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। সংগৃহীত ছবি
>

বসুন্ধরা কিংসে ট্রায়াল দিতে এসেছেন আফগানিস্তানের ফুটবলার মাশি সাইগানি

‘আমি নিশ্চিত আফগানিস্তান জিতবে।’

বাংলাদেশের ২৪৯ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে আফগানিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ তখন কিছুটা হলেও কাঁপছে। ১৪ ওভারের খেলা চলছে। দুই উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে ৪৫ রান। তবু তাঁর অগাধ বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত ঠিকই জয়ের ঠিকানা খুঁজে নেবে আফগানিস্তান। কে না চায় নিজ দেশের জয় দেখতে? তাই ঢাকায় বসেও বাংলাদেশকে হারিয়ে আফগানিস্তানের জয়ের প্রত্যাশা করেন মাশি সাইগানি।

আফগানিস্তান জাতীয় দলের এই ফুটবলার এসেছেন বসুন্ধরা কিংসের ট্রায়ালে। পরশু রাতে ক্লাবে বসেই বাংলাদেশ-আফগানিস্তান ধুন্ধুমার লড়াইয়ের কিছু অংশ দেখলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। রাত বেড়ে যাওয়ায় খেলার মাঝপথেই বিদায় নেওয়া। তাই আর জানা গেল না পরাজয়ের কষ্টের তীব্রতাটা। তবে আন্দাজ তো করে নেওয়া যায়!

সাইগানির বেড়ে ওঠা জার্মানিতে। তাই আফগান হলেও ক্রিকেটের প্রতি তেমন কোনো আকর্ষণ নেই। কিন্তু মাতৃভূমি আফগানিস্তান যখন মাঠে নামে, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্বদেশি বন্ধুদের ঝড় তোলা দেখে একটু খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেন। আফগানিস্তানের খেলা হলে টিভির সামনে বসার আরেকটা কারণ অবশ্য আছে—রশিদ খান। বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানকে ঘোল খাওয়ানো এই স্পিনার সাইগানির বন্ধু।

ক্রিকেটের মাত্র তিনটি বিষয় জানা আছে ৩১ বছর বয়সী এই ফুটবলারের। জয়–পরাজয়, বোল্ড আউট ও ক্যাচ আউট। পরের দুটি জানা হয়েছে রশিদের সৌজন্যে। বেশি দিন আগে নয়, দুজনের পরিচয় ২০১৫ সালে। সেবার ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হয় আফগানিস্তান। দেশে ফিরলে দেওয়া হয় সংবর্ধনা। সে অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ক্রিকেটাররাও। সেখানেই একই অঙ্গনের দুই ছাদের দুই তারকার বন্ধুত্ব। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে হাই-হ্যালো ও শুভেচ্ছা বিনিময় থেকেই ভালো বন্ধু হয়ে ওঠা, ‘এক অনুষ্ঠানে আমাদের পরিচয়। এরপর থেকেই ভালো বন্ধুত্ব। দুজন দুজনের খোঁজখবর রাখি। শুভেচ্ছা জানাই।’

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের নবাগত ক্লাব বসুন্ধরাতে ট্রায়াল দিতে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে আছেন ঢাকায়। এর মধ্যেই সতীর্থদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বটা জমে উঠেছে বেশ। অনুশীলন ও বিশ্রামের পর সুযোগ হলে মাঝে মাঝে যান শপিংয়ে। ঢাকায় গরম ছাড়া নাকি সবই ভালো লাগে তাঁর। চার দিন আগে নীলফামারীতে গিয়ে খেলেছেন নিউ রেডিয়ান্টের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ। সেখানকার মানুষের ফুটবল ভালোবাসার গল্পও এখনো লেগে আছে তাঁর ঠোঁটের আগায়।

আজকের হাসি খুশি মানুষটার পেছনের গল্পটা অনেক রোমাঞ্চের। যেখানে আছে অনেক চড়াই-উতরাই। নিজেই শোনালেন সেই গল্প। হামাগুড়ি দেওয়ার বয়সে বাবার হাত ধরে মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন জার্মানিতে। চারবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের দেশে কেটেছে কৈশোর আর যৌবন। তারুণ্যের গোধূলিলগ্নে এসে সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের হয়ে খেলার। ব্যস, ট্রায়ালে নাম লেখানো এবং ফুটবলের সৌজন্যেই ২৬ বছর পর মাতৃভূমি আফগানিস্তানে ফেরা।

ঢাকার একটি অভিজাত বিপণি কেন্দ্রে মাশি সাইগানি। সংগৃহীত ছবি
ঢাকার একটি অভিজাত বিপণি কেন্দ্রে মাশি সাইগানি। সংগৃহীত ছবি

কাবুলের বনেদি পরিবারে জন্ম। ডাক্তার বাবা ও আইনজীবী মায়ের শাসন ও স্নেহে ভালোই চলছিল চার ভাইবোনের জীবন। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁদের জীবনকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেয়। উন্নত ভবিষ্যতের আশায় ১৯৮৯ সালে তাই স্বদেশের মায়া ছেড়ে পাড়ি জমালেন জার্মানিতে। স্কুলের পড়াশোনার সঙ্গে ধীরে ধীরে ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাইগানির। কৈশোরে পড়লেন ফুটবলের প্রেমে। ফুটবল তাঁকে দুহাত ভরে না দিলেও হতাশ করেনি। জার্মানির চতুর্থ ও পঞ্চম ডিভিশনে ১১ বছর খেলেছেন। আর ২৬ বছর পর সাইগানির জন্মভূমিতে ফেরার নেপথ্য কারণও ফুটবল!

২০১৫ সাফ ফুটবলের আগে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে আফগানিস্তান ফুটবল ফেডারেশন। শক্তিশালী জাতীয় দল গঠনের জন্য জার্মানি এবং আশপাশের দেশগুলোতে অবস্থানরত আফগান বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় বাছাইয়ের। সেই পরীক্ষায় নাম লিখিয়ে সাইগানি আফগান জাতীয় দলের কোচের মন জেতেন। পরে কেরালায় অনুষ্ঠিত সাফ টুর্নামেন্টে দুই গোল করে দেশকে রানার্সআপ করতে বড় ভূমিকাও রেখেছিলেন ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার এই হোল্ডিং মিডফিল্ডার।

সাইগানি দেশ ছেড়েছিলেন মাত্র ২ বছর বয়সে। দুই যুগেরও বেশি সময় পরে আফগানিস্তানে ফিরলেও দেশে থাকতে পেরেছেন মাত্র দুই দিন। তা ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্যই। এ নিয়ে তাঁর আফসোসও আছে, ‘২৬ বছর পরে আফগানিস্তানে ফেরা। কিন্তু মাত্র দুই দিন থাকতে পেরেছি। কারণ তখনো প্রতিদিনই বোমার শব্দ শোনা যেত। তাই পরিবারের চাপে আর থাকা হয়নি।’ সাইগানি তবু দুই দিনের জন্য জন্মভূমিতে ফিরেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের দেশে ফেরার কোনো আগ্রহ নেই।

সাফে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করার পর ভারতীয় ক্লাবগুলোর নজরে আসেন দীর্ঘদেহী এই আফগান। এ সুযোগেই জার্মানির বাইরে এসে প্রথমবারের মতো নাম লেখান ভারতের ঘরোয়া লিগে। বসুন্ধরায় আসার আগে ভারতীয় আই লিগের ২০১৬-১৭ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন আইজল এফসিতে খেলেছেন। চলতি বছর আইজলের হয়ে বাংলাদেশে এসে খেলেছিলেন এএফসি কাপের ম্যাচও। আবাহনীর বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র হওয়া ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেছিলেন এই হোল্ডিং মিডফিল্ডার। ব্যস, এবার তাঁকে ডেকে এনেছে শুরুতেই দেশের ফুটবলে একের পর এক চমক উপহার দেওয়া বসুন্ধরা। যদিও এখনো চুক্তি হয়নি। না হলে ফিরে যাবেন ফিরে যাবেন জার্মানিতে। কিন্তু দেশে ফেরা নয় কেন? জবাবটা তাঁর ঠোঁটে লেগেই ছিল, ‘আপনি হয়তো জানেন, আফগানিস্তানে বোমা লেগেই আছে। এমন অবস্থায় কি দেশে ফেরা যায়?’

সাইগানির এই কথা শুনলে মনে হতে পারে জাতীয় দলে খেললেও দেশের প্রতি তাঁর কোনো মায়া জন্মায়নি। ভুল। মাঠে নামলে তাঁর জার্সির নিচে গেঞ্জিতে লেখা থাকে, ‘প্রে ফর আফগানিস্তান’—আফগানিস্তানের জন্য প্রার্থনা করুন। ভারতে সদ্য সমাপ্ত সুপার কাপে সাইগানির দল জিতলে দৃশ্যটি নিয়মিতই দেখা যেত। জার্সি উঁচিয়ে নিচের গেঞ্জিতে এই লেখা তুলে ধরতেন ভারতীয় গণমাধ্যমের সামনে। ট্রায়ালে টিকে গেলে বসুন্ধরার জার্সির নিচেও হয়তো গেঞ্জি লেখা থাকবে ‘প্রে ফর আফগানিস্তান’।