শিরোপার দুঃখ কি ঘুচবে এবার?

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের লবিতে এক সাংবাদিক আঙুলের কী অবস্থা জানতে চাওয়ায় মাশরাফি বিন মুর্তজা নির্বিকার মুখে রসিকতা করেন, ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ।’

ডান হাতের কড়ে আঙুলে টেপ জড়ানো। আগের রাতে শোয়েব মালিকের ক্যাচ ধরতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন। মাশরাফির তা নিয়ে একটুও দুঃখ নেই। শর্ট মিড উইকেটে শূন্যে লাফিয়ে নেওয়া ওই ক্যাচটাই যে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের বিপক্ষে অলিখিত সেমিফাইনালের।

মাশরাফি তাই ফুলে যাওয়া আঙুলে হাত বোলাতে বোলাতে হাসতেও পারেন, ‘পরিস্থিতিটা শোয়েব মালিকের জন্য খুব আদর্শ ছিল। ও থাকলে ঠিকই ম্যাচ বের করে নিত। আমাদের কম্পিউটার অ্যানালিস্ট মিটিংয়ে বলেছিল, শোয়েব শর্ট মিড উইকেটে প্রায়ই ক্যাচ দেয়। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে তাই ভাবছিলাম, আহা, ও যদি আরামসে ধরার মতো একটা ক্যাচ তুলে দিত। ক্যাচ দিল ঠিকই, তবে এমন জোরে মেরেছিল...।’ বলার পর আরও বেশি করে হাসেন, ‘জোরে মারাতে ভালোই হয়েছে। ক্যাচটা হাতে জমে গেছে।’

এই এশিয়া কাপের ঠাসা সূচিতে ক্রিকেটারদের রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা। ফাইনালের আগেও মাত্র এক দিনেরই বিরতি। বিকেল নাগাদ নির্ঘাত পরিস্থিতিটা বদলে গেছে, তবে দুপুর পর্যন্ত পরদিনের ফাইনালের বদলে আগের দিনের ম্যাচই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বাংলাদেশ দলকে। দিন তো শুরুই হলো দুপুরের পর। আগের রাতে আবুধাবি থেকে দুবাইয়ের হোটেলে ফিরতেই যে রাত তিনটা বেজে গেছে।

মাশরাফি তাই ফাইনালের আগে আরেকটি দিন হাতে পেলে ভালো হতো বলে আক্ষেপ করেন। আবার পরক্ষণেই বলেন, ‘এ নিয়ে ভেবে কী লাভ! যে অবস্থা থেকে আমরা ফাইনালে উঠেছি, এখন আর কোনো কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা করি না।’

দুশ্চিন্তা করলে তা একটা কারণেই করা উচিত। ম্যাচটা ফাইনাল বলে। ‘ফাইনাল’ কথাটাই একসময় রোমাঞ্চ ছড়িয়ে দিত বাংলাদেশ দলে। ফাইনালে উঠতে পারাই ছিল বুক ফুলিয়ে বলার মতো এক অর্জন। অনেক দিনই আর তা নয়। সর্বশেষ চারটি এশিয়া কাপেই তো বাংলাদেশের এটি তৃতীয় ফাইনাল। এখন ‘ফাইনাল’ মানে অন্য প্রশ্ন—এবারও কি সেই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা?

দুই বছর আগের এশিয়া কাপ ছিল টি–টোয়েন্টির। সেটির ফাইনালে ভারতের কাছে পাত্তাই মেলেনি। ৫০ ওভারের এশিয়া কাপে এর আগে বাংলাদেশের একটিই ফাইনাল । ২০১২ সালে মিরপুরের যে ফাইনাল হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের চিরন্তন এক দুঃখগাথা। পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে হারার পর মাঠেই সাকিব–মুশফিকদের ওই কান্না আর সেটির ছোঁয়াচে হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া। সেই ফাইনালের তিনজন এবারও আছেন। মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক ও মাশরাফি নিজে। এশিয়া কাপের বাইরেও কখনো ত্রিদেশীয় সিরিজ, কখনো বা নিদাহাস ট্রফির ‘ফাইনাল’ শুধু দুঃখই উপহার দিয়ে গেছে বাংলাদেশকে। এ নিয়ে বেশি চর্চায় হিতে বিপরীত হতে পারে অনুমান করেই হয়তো মাশরাফি ট্রফি জয়ের আলোচনাতেই যেতে চাইলেন না।

শুরুর আগে এই এশিয়া কাপটাকে রসিকতা করে অনেকে বলছিলেন ‘ভারত–পাকিস্তান তিন ম্যাচের সিরিজ।’ তিনটি ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ পেতেই তো দুই দলকে এক গ্রুপে রেখে ‘সুপার ফোর’ নামের অভূতপূর্ব ছক। সেই ছক এলোমেলো করে দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয় সাংবাদিকদের অনেককেই এতে খুব খুশি দেখাল। ভারত–পাকিস্তান চিরন্তন সেই ঝাঁজ হারিয়ে ফেলায় এশীয় ক্রিকেটের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাকি এই বাংলাদেশ–ভারত। সংবাদের ভোক্তাসমাজ নাকি এটাই বেশি ‘খায়!’

ক্রিকেটারদের মধ্যে অবশ্য সেই ঝাঁজের কোনো ছাপ নেই। ভারতের বিপক্ষে খেলার সময় কি বাড়তি একটা জেদ কাজ করে মনে? প্রশ্নটাকে যেমন পাত্তাই দিলেন না মাশরাফি, ‘জেদ দিয়ে ক্রিকেট খেলা হয় না। খেলাটা হলো স্কিল আর মানসিক শক্তির। ভালো খেললে আপনি জিতবেন। ভারত যেসব ফরম্যাট মিলিয়ে আমাদের বিপক্ষে সর্বশেষ ১০টা ম্যাচ জিতেছে, সেটি ভালো খেলেছে বলেই। আমরা যে ২০১৫ সালে জিতেছিলাম, সেটিও ভালো খেলেছিলাম বলেই।’

দুই দেশের ক্রিকেটীয় উত্তেজনায় জল ঢেলে দেওয়ার আসল কাজটা অবশ্য করলেন ভারতীয় দলের সহ–অধিনায়ক শিখর ধাওয়ান। এতটাই যে সংবাদ সম্মেলনে এক ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে লেগেই গেল তাঁর। ধাওয়ান বাংলাদেশের শুধুই প্রশংসা করে যাচ্ছেন দেখে ওই সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘এত যে প্রশংসা করছেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কী জিতেছে?’ ধাওয়ান পাল্টা প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশ কত বছর ধরে টেস্ট খেলছে?’ উত্তরটা পেয়ে আরেক দফা প্রশংসা।

মাঝখানে বাংলাদেশ–ভারত মুখোমুখি হলেই যেখানে আগুনের ফুলকি ছুটত, সেখানে এবার চারপাশে শান্তি–শান্তি রব। ব্যতিক্রমীই বলতে হবে। বাংলাদেশের ফাইনাল–ভাগ্যেও কি ব্যতিক্রমী কিছু লেখা হয়ে আছে এবার!

কে জানে!

আরও পড়ুন: