ব্র্যাডম্যানের গড় ১০০ না হওয়ার দায় যাঁর!

অভিষেক টেস্টে ইনিংস খেলে ফিরছেন হার্ভে। সংগৃহীত ছবি
অভিষেক টেস্টে ইনিংস খেলে ফিরছেন হার্ভে। সংগৃহীত ছবি

ওভাল টেস্টে না খেললেও পারতেন। তাহলে ক্রিকেট রূপকথায় সেই ‘অনন্ত আক্ষেপ’-এর জন্ম হতো না। বরং ব্যাটিংয়ের ‘ম্যাজিক ফিগার’টা টিকে যেত। আর সেটি ঘটলে গত ৭০ বছর ধরে অনুশোচনার আগুনে পুড়তে হতো না নিল হার্ভেকে। একটি বাউন্ডারি মারার আনন্দ কখনো-সখনো তির হয়ে বেঁধে বুকের মাঝখানে!

বুকের তিরটা এখনো লালন করছেন হার্ভে। জীবনের বাইশ গজে তা আর খুলছে না, বরং যন্ত্রণা বাড়ছে। হার্ভে হয়তো ভাবেন, ইশ্‌! জীবনের উল্টো পথে হেঁটে যদি ফিরিয়ে আনা যেত উনিশ শ আটচল্লিশকে। তাহলে ওই চারটি রান করাতাম ডনকে দিয়ে!

ডন? ক্রিকেট ভালো লাগলে নামটা অবশ্যই শুনেছেন। ব্যাটিংয়ের ডন। সেই যে বেঁটেমতো লোকটা। ৯৯.৯৪! সেই অবিশ্বাস্য ব্যাটিং গড়। আটচল্লিশের অ্যাশেজে শেষ টেস্ট ছিল ডন ব্র্যাডম্যানেরও শেষ। শেষের মঞ্চে মাত্র ৪টা রান করলেই ডনের ব্যাটিং গড় হতো ১০০! কিন্তু ডন মারলেন শূন্য। ব্যস, জন্ম নিল ক্রিকেট ইতিহাসে ‘অনন্ত আক্ষেপ’-এর গল্প।

অস্ট্রেলীয়রা দুষে থাকেন এরিক হোলিসকে। এই ইংলিশ স্পিনারের গুগলিই তো হতে দেয়নি! শুধু অস্ট্রেলীয়রা কেন, হোলিস নামটা ক্রিকেটের আমজনতা পর্যন্ত পৌঁছেছে ওই আউটটির জন্য। যে কারণে ডনের ব্যাটিং গড় ১০০ হয়নি। ভুল। হার্ভের দাবি অন্তত এমনই। আসল দোষী তো তিনি!

হার্ভের দাবিটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। সে যাই হোক, ডনের প্রতি হার্ভের হৃদয়ের দাবিটা কিন্তু এ দাবিতে পরিষ্কার, নিখাদ ভালোবাসা। প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। মাঠে দুজন বিচ্ছিন্ন হওয়ার ৭০ বছর পরও, এই না হলে সতীর্থ!

কুড়ি বছর বয়সের ফারাক ছিল দুজনের। ডন অনেকটাই বাবার মতো ছিলেন হার্ভের কাছে। শ্রদ্ধা করতেন ভীষণ। ১৯৪৮-এ ভারতের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে হার্ভের অভিষেক। পরের ম্যাচেই গড়লেন অস্ট্রেলিয়ার কনিষ্ঠতম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড। ব্যস, সঙ্গী হিসেবে জায়গা পেয়ে গেলেন ইংল্যান্ডে ডনের শেষ সফরে।

খবর শুনে হার্ভের মা তো ভীষণ খুশি। যাক, ছেলে তাহলে ইংল্যান্ডে ডনের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেল! এদিকে ছেলে তো মহা দুশ্চিন্তায়। নিজের কোনো ব্যাট নেই, প্যাড নেই, নেই প্রায় কিছুই! আটচল্লিশের সেই সফরের মাঝপথে হার্ভে নিজের ‘ক্রিকেট কিটস’ পেয়েছিলেন উপহার হিসেবে। তার আগে ভারতের বিপক্ষে অভিষেকের আগে ১০ ডলার দিয়ে একটা ব্যাট কিনলেও সেঞ্চুরির সময় হাতল ভেঙে গিয়েছিল। ধার করা ব্যাট দিয়ে ইনিংস শেষ করতে হয়েছিল। বেশির ভাগ সময় ক্লাবের ‘কিটস’-ই ছিল ভরসা।

ডনের সেই দলে হার্ভে ছিলেন কনিষ্ঠতম সদস্য। আর্থার মরিস-রে লিন্ডওয়ালদের চোখে পুঁচকে ছোড়া। ইংল্যান্ডে হার্ভের শুরুটাও ছিল তেমনই। প্রথম তিন ম্যাচে ব্যাটিং গড় ৭! স্যাম লোক্সটনকে ধরলেন হার্ভে। ‘ভাই, ওস্তাদকে (বস) একটু জিজ্ঞেস করবে, ভুলটা কোথায় হচ্ছে?’

লোক্সটন ঘুরে এসে ‘টোটকা’ দিলেন হার্ভিকে, ‘ডন বলেছে, তোমার পুঁচকে সতীর্থকে বলো, নিচে খেললে (গ্রাউন্ড) সে আউট হবে না।’

টোটকা কাজে দিল লিডসে চতুর্থ টেস্টেই। প্রথম ইনিংসে ৪৯৬ রান তুলেছিল ইংল্যান্ড। জবাবে ৬৮ রানেই ৩ উইকেট পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার। এখান থেকে কিথ মিলার-হার্ভের ঝোড়ো ১২১ রানের জুটিতে লড়াইয়ের পথ খুঁজে পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ৪৫৮ রান তুলে ম্যাচে ভারসাম্য এনেছিল হার্ভের ১১২ রানের ইনিংসে। দ্বিতীয় ইনিংসেও ইংল্যান্ড ভালো ব্যাট করেছে। ৮ উইকেটে ৩৬৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করেছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক নরম্যান ইয়ার্ডলি। ভেবেছিলেন, একদিনেরও কম সময় পাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। এর মধ্যে ৪০৪ রানের টার্গেট তাড়া করে জেতার চেষ্টা করবে কোন বোকা! সেই চেষ্টা করলে উল্টো হারতে হবে।

এমন অলিগলিতে খেলে বেড়ে উঠেছেন, তাই খেলা শেখানোর জন্য গলিকেই বেছে নিয়েছেন। সংগৃহীত ছবি
এমন অলিগলিতে খেলে বেড়ে উঠেছেন, তাই খেলা শেখানোর জন্য গলিকেই বেছে নিয়েছেন। সংগৃহীত ছবি

ভুল। চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে ডন ও মরিস মিলে ভুল প্রমাণ করেছিলেন ইয়ার্ডলিকে। মরিসের ১৮২ আর ডনের অপরাজিত ১৭৩ রানে জয়ের ভিত গড়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিথ মিলার এসে ১২ রানে ফিরে গেলে উইকেটে আসেন হার্ভে। জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার তখন মাত্র ৪ রান দরকার। হার্ভে স্ট্রাইকে, প্রথম বলেই বাউন্ডারি মেরে ৪ রান তুলে নেন।

তখন কে জানত, এই বাউন্ডারিই হার্ভিকে সারা জীবন পোড়াবে অনুশোচনার আগুনে। ইংলিশ ভরাডুবির জন্য ওভালে মাত্র এক ইনিংস ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। আর সেই ইনিংসেই ডনের ওই বিখ্যাত ‘ডাক’। যেন অলক্ষ্যের কোনো লেখকের লেখা ভীষণ সফল কোনো চিত্রনাট্যের বিয়োগান্ত পরিণতি। হার্ভে মনে করেন, এই পরিণতির জন্য আসল দোষী তিনি নিজে। লিডস টেস্টে ওই চারটি রান তিনি ডনকে দিয়ে করালেই পারতেন। তাহলে ১০০ গড় নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারেন ডন, ‘লিডসের সেই ৪ রান আমাকে ভীষণ পোড়ায়। টেস্টে ব্র্যাডম্যানের ১০০ গড় না হওয়ার দায়টা সম্পূর্ণ আমার। আমার বদলে সে ওই চার রান করলে কাজটা হয়ে যেত’—বুড়ো বয়সে এসে হার্ভের আর্তি।

তখন পরিসংখ্যানের এত কচকচানি ছিল না। লিডসে ব্যাটিংয়ের সময় হার্ভে জানতেন না, ১০০ গড় পেতে ডনের সেই ৪ রানের সমীকরণটা। ডন ওভাল টেস্টে না খেললে ১০১.৩৯ ব্যাটিং গড় নিয়ে যে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারতেন, সে কথাও অনেকে জানত না। সাদা চোখে তাই ডনের ১০০ গড় না হওয়ার জন্য হার্ভের নিজেকে ‘দোষী’ মনে করার ব্যাপারটি বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিংবা ডনের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সতীর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে?

হার্ভের ভাষায়, ‘সব দায় আমি নিতে চাই। তখন এত পরিসংখ্যান ছিল না, টিভি ছিল না, সংবাদমাধ্যমও ব্যাপারটা সেভাবে জানত না। কেউ জানত না ১০০ গড়ের জন্য লিডসে ব্র্যাডম্যানের আর ৪ রান দরকার… ওভালে শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসেও। ওই আউটের পরই সব শেষ। আর সুযোগ মেলেনি। কারণ প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডকে আমরা ৫২ রানে অলআউট করেছিলাম।’

সেবার ইংল্যান্ডে প্রায় ছয় মাসের সফরে কোনো ম্যাচ (৩৪ ম্যাচে ২৫ জয়, ৯ ড্র) হারেনি ব্র্যাডম্যানের দল। ‘ইনভিন্সিবল’ তকমা পাওয়া সেই দলটা ক্রিকেট রূপকথার অংশ। সেই দলটার সবাই যেতে যেতে টিকে আছেন শুধু হার্ভে। ‘ইনভিন্সিবল’-এর একমাত্র জীবিত সদস্য, যাঁর ফুটওয়ার্ক এত ভালো ছিল যে কখনো স্টাম্পিং হননি। জীবনের উইকেটের সায়াহ্নে এসে হার্ভে বুঝি ডনের মতোই ব্যাটিং করতে চান? তাই বেঁচে থাকতে উগরে দিলেন এত দিনের সেই পোড়া ক্ষত? যা অন্যলোকে পাড়ি জমানো ডন পেলেন অর্ঘ হিসেবে।

ডন ক্রিকেটের বাইশ গজে কখনো ‘নার্ভাস নাইন্টিজ’-এ আউট হননি। আজই নড়বড়ে নব্বইয়ে ঢোকা হার্ভের এই আর্তি কি ওপারে গিয়ে ‘সরি মেট’ বলার প্রস্তুতি?