মোহামেডান এখন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য খেলে না!

মোহামেডান এখন ভালো দল গড়ে না। ছবি: প্রথম আলো
মোহামেডান এখন ভালো দল গড়ে না। ছবি: প্রথম আলো
>

মোহামেডান এখন আর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য দল গড়ে না। কর্মকর্তাদের লক্ষ্য নাকি চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়। দেশের অন্যতম দর্শকপ্রিয় এই ক্লাব এবার দল গড়েছেন বাতিল ও প্রায় বাতিল হতে বসা ফুটবলারদের নিয়ে। 

একসময় সাদা-কালে জার্সি রক্তে কাঁপন ধরাত লাখো ফুটবলপ্রেমীর। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব নামটা ছিল আবেগের অপর নাম। একের পর এক সাফল্য দিয়ে সমর্থকদের মন জয় করা দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবের অভিধানে ‘ব্যর্থতা’ শব্দটিরই কোনো স্থান ছিল না। অতীতে যে ক্লাবে খেলোয়াড়, সমর্থক, কর্মকর্তাদের কাছে লিগে বা যেকোনো টুর্নামেন্টে ‘দ্বিতীয়’ হওয়াটাই ছিল অচিন্তনীয় ফল, তারা নাকি এখন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যে দল গড়ে না। সাদা-কালো শিবিরের কর্মকর্তারা এখন গণমাধ্যমের সামনে বেশ গর্বের সঙ্গেই বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়।’

মাত্র কয়েক দশক। এর মধ্যেই দেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই ক্লাবে হাল যে এমনটা হবে, সেটি কে জানত। মোহামেডান-অন্তঃপ্রাণ ফুটবলপ্রেমীদের ভরসা এখন অতীতের চর্বিত-চর্বণ। সাংগঠনিক দুর্বলতা যে শীর্ষ একটি প্রতিষ্ঠানকে এমন খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করাতে পারে, সেটি আসলে চোখ না দেখলে বিশ্বাস করা খুব কঠিন। ভাবা যায়, মোহামেডানের মতো ক্লাব সর্বশেষ লিগ-সাফল্য পেয়েছে আজ থেকে ১৬ বছর আগে, ২০০২ সালে!

নতুন মৌসুম শুরুর আগে দল গোছানোর কাজ শেষ করেছে মোহামেডান। যে দলটি একসময় গঠিত হতো দেশের সেরা তারকাদের নিয়ে, তাদেরই এখনকার ভরসা এমন এক দল ফুটবলার, যাঁরা নিজেদের সেরা সময়টা পেছনে ফেলে এসেছেন অনেক আগেই। এমন খেলোয়াড়দের ওপর যে ক্লাবের কর্মকর্তারা ভরসা রাখেন, তাঁরা তো গণমাধ্যমের সামনে ‘আমাদের লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়’ বলবেনই। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম কথা যে আর কিছুই হতে পারে না!

আসন্ন মৌসুমে মোহামেডান যে খেলোয়াড়দের নিয়েছে, তাঁদের পায়ে ঝলক নেই অনেক দিন হতে চলেছে। ফুটবলপাড়ায় দর্শকদের কাছে এঁদের বেশির ভাগই ‘বাতিল খেলোয়াড়’ হিসেবে সুপরিচিত। কেউ কেউ আবার ক্যারিয়ারের একেবারে গোধূলিবেলায় দাঁড়িয়ে আছেন। লিগে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য ক্লাবগুলো যেখানে নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে শক্তিশালী দল গড়ার চেষ্টা করেছে, সেখানে মোহামেডান ছিল দিবানিদ্রায় শুয়ে। দলবদলের শেষ দিনে প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া খেলোয়াড়দের নিয়ে মোহামেডানের কর্তারা যখন ‘লড়াই করা’র গল্প শোনান, তখন সেটিকে অক্ষমের আখ্যান বললে খুব বেশি ভুল হবে না।

তবে এক মৌসুম আগে প্রায় অবনমনের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া মোহামেডানের কর্তারা কিছুটা হলেও সাবধানী। গত মৌসুমে ক্যারিয়ারের প্রান্তসীমায় চলে যাওয়া খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গড়ে অন্তত অধঃপতন ঠেকাতে পেরেছিলেন তাঁরা। এবার তাই আগের খেলোয়াড়দের ধরে রেখে কয়েকজন ‘ভালো’ ফুটবলার নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই ‘ভালো’ ফুটবলাররাও নিজেদের সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। সমর্থকদের কাছে দলটাকে তাই ‘থোড় বড়ি খাঁড়া, খাঁড়া বড়ি থোড়’ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। নিজেদের প্রিয় ক্লাবটাকে তাই তাদের মনে হচ্ছে পুনর্বাসনের মঞ্চ।

ক্যারিয়ারের ভালো সময় পার করেই গত মৌসুমে মোহামেডানে এসেছিলেন জাতীয় দলের এক সময়ের সফল স্ট্রাইকার জাহিদ হাসান এমিলি। তিনি ক্লাব কর্তাদের মুখপাত্র হয়েই আশার কথা শোনাতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, এবার মোহামেডানের মূল ভরসা হতে যাচ্ছেন চারজন ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড়, ‘কয়েক বছর ধরে দেখা গেছে যারা ভালো মানের বিদেশি নিয়েছে, তারাই ভালো করেছে। আমরা গত মৌসুমে ভালো বিদেশি নিতে পারিনি। এ জন্যই দল ভুগেছে। এবার আমাদের বিদেশি চারজনই বেশ ভালো মানের। এর সঙ্গে আমরা অভিজ্ঞ কয়েকজন দায়িত্ব নিয়ে খেললে গতবারের চেয়ে আশা করি ভালো করতে পারব।’

মোহামেডানের চার বিদেশির মধ্যে আছেন ঢাকা মাঠের অভিজ্ঞ ল্যান্ডিং দারবোয়ে। গাম্বিয়ান এই ফুটবলার গত মৌসুমে খেলেছেন আবাহনীতে। এ ছাড়া নাইজেরিয়ার এনকোচা কিংসলেকে রেখে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এশিয়ান কোটায় জাপানি ফুটবলার উরুই নাগাতাকে দলে নিয়েছে তারা। এই নাগাতা অস্ট্রেলীয় লিগের অভিজ্ঞতা নিয়ে খেলতে এসেছেন মোহামেডানে। গত মৌসুমে তিনি খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্ট ইউএফসিতে। এঁদের সঙ্গে আরেক নাইজেরীয় এবার সাদা-কালো জার্সি গায়ে চাপাবেন। তিনি হচ্ছেন সেরিল চেতাছি ওরাইকু।

মোহামেডানে এবার দেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন জাহিদ হাসান এমিলি, মিঠুন চৌধুরী, মোহাম্মদ লিঙ্কন, এনামুল হক শরীফ, মিন্টু শেখ, তকলিস আহমেদ। এঁরা সবাই পুরোনো। গত মৌসুম খেলেছেন সাদা-কালো জার্সি গায়ে। এবার যোগ দিয়েছেন শেখ রাসেলের ডিফেন্ডার আতিকুর রহমান মিশু, মুক্তিযোদ্ধার গোলরক্ষক আহসান হাবিব বিপু, সাইফ স্পোর্টিংয়ের ডিফেন্ডার জহিরুল ইসলাম, রহমতগঞ্জের মিডফিল্ডার ইউসুফ সিফাত। এঁদের নিয়ে ইংলিশ কোচ ক্রিস্টোফার ইভান্স থাকছেন ডাগআউটে। মোটামুটি গড়পড়তা মানের একটি দল নিয়ে কোচ কত দূর যাবেন, সেটি সময়ই বলে দেবে।

দল ভালো হয়নি। কর্মকর্তাদের চিন্তাভাবনা সংকীর্ণ। সাংগঠনিক দৈন্য সর্বত্র। এত কিছুর পরেও মোহামেডানের সমর্থকেরা প্রিয় দলের সাফল্যই চাইবেন। আশায় বুক বাঁধবেন। খেলাধুলায় ‘মিরাকল’ বলে তো একটা কথা আছে। সেটা মোহামেডানের বেলায় কেন খাটবে না। কর্মকর্তাদের ‘আমাদের লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়’ কথাগুলো যে সমর্থকদের কাছে বড্ড অসহ্য।