ফুটবল মাঠে কেন নাশপাতি আর বাঁধাকপি?

ফ্যাব্রিগাসের হাতে ‘সেলেরি’। সমর্থকদের ‘উপহার’ (!) ছবি: এএফপি
ফ্যাব্রিগাসের হাতে ‘সেলেরি’। সমর্থকদের ‘উপহার’ (!) ছবি: এএফপি

ফুটবলে কোচ আর খেলোয়াড়েরাই দর্শকদের প্রাণ। সেই প্রাণে আছে সুখ-দুঃখ ক্ষোভ আর অভিমান। এসব অনুভূতির বশে দর্শকেরা গ্যালারিতে বসে কী কাণ্ডই না করেন! কত আবেগী সব ব্যানার। কৌতুকপূর্ণ কথা আর তির্যক মন্তব্য। ক্ষোভ দমিয়ে রাখতে না পারলে অনেকের আবার ছুড়ে মারার অভ্যাসও আছে। না, নিজেকে নয়—অন্য যে কোনো কিছু। যেমন ধরুন, লুই ফিগোর জন্য ‘ভেট’(!) হিসেবে শূকরের মাথা। আবার শাক-সবজি কিংবা ফল-মূল ছুড়ে মারার প্রবণতাও কম নয়। ইউরোপিয়ান ফুটবলে এমন ‘নজরানা’ (!) পেশের হার বেশি। হয়তো কিনতে সস্তা, কে জানে!

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’ দর্শকদের এ নিয়ে বেশ মজার সমীক্ষা চালিয়েছে। মাঠে কোচ-খেলোয়াড়কে উদ্দেশ্য করে কী, কী শাক-সবজি কিংবা ফল-মূল ছুড়ে মারা হয়েছে? এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ অক্টোবরের শুরুতে ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপে অ্যাস্টন ভিলা-প্রেস্টন ম্যাচটি। ৩-৩ গোলে ড্র হওয়া কোলাহলপূর্ণ সেই ম্যাচে ভিলা কোচ স্টিভ ব্রুসকে সমর্থকেরা বাঁধাকপি ছুড়ে মেরেছিলেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাঁধাকপি এ ধরনের ভেট প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ সমাদৃত সবজি। আর শালগম?

১৯৯৪-১৯৯৫ মৌসুমের কথা। সেটিও ছিল চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ। বোল্টন ওয়ান্ডার্সের কাছে ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত হলো উলভহ্যাম্পারটন। হারের দুঃখে ডাগ আউটে বসে ছিলেন উলভ কোচ গ্রাহাম টেলর। হঠাৎ পেছনের গ্যালারি থেকে আস্ত একটা শালগম তাঁর কানের ডগায় বাতাস বুলিয়ে মাঠে ভূপাতিত। এভাবে আরও দুটো! সেই ম্যাচের এক প্রতিবেদনে সরস মন্তব্য ছিল ‘তিনটার একটাও লাগেনি। বাজে লক্ষ্যভেদের হাত।’

সাউদাম্পটন সমর্থকদের নিশানা অবশ্য মন্দ নয়। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে দলটির কোচ হিসেবে মোটেই ভালো করতে পারছিলেন না ইয়ান ব্রানফুট। উল্টো দলের ভালো ভালো খেলোয়াড়দের বসিয়ে রাখতেন বেঞ্চে। সমর্থকেরা সহ্য করতে পারেনি। সিদ্ধান্ত হলো কোচকে রগড়ানি দেওয়া হবে। এক ম্যাচে গ্যালারি থেকে একটা সুগন্ধি কমলালেবু সোজা ব্রানফুটের মাথায় আছড়ে পড়ল। কয়েক দিন প্রশ্ন উঠেছিল, কে মারল ! কে মারল! প্রচুর ‘সেইন্ট’ সমর্থক দাবি করলেন, আমি মেরেছি, আমি মেরেছি।

দর্শকদের ছুড়ে মারা কলা তুলে নিয়ে খাচ্ছেন আলভেজ। ছবি: টুইটার
দর্শকদের ছুড়ে মারা কলা তুলে নিয়ে খাচ্ছেন আলভেজ। ছবি: টুইটার

ফলকে কল্পিত ‘শেল’ বানিয়ে ছোড়ার ঘটনা রয়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের বাইরেও। বেশি না, মাত্র পাঁচ বছর আগের ঘটনা। সুইডিশ ফুটবলের শীর্ষস্থানীয় লিগে মুখোমুখি জারবে-জুগারদেন। ম্যাচটা রেফারির শেষ বাঁশিতে শেষ হয়নি, শেষ করেছিল একটি নাশপাতি! জারবের ডিফেন্ডার বেঙ্গা আরোকায়োকে নাশপাতি ছুড়ে মেরেছিলেন এক দর্শক। আচমকাই মাথায় তা আছড়ে পড়ায় মাঠেই ভূপাতিত বেঙ্গা। অফিশিয়ালরা সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবে ম্যাচ চলতে দেওয়া যায় না। ম্যাচ পরিত্যক্ত তবে জারবে ৩-০ গোলে জয়ী। সামান্য এক নাশপাতির সৌজন্যে ম্যাচটা পুরোপুরি না খেলেই এই জয় উপহার পেয়েছিল জারবে।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোচ-খেলোয়াড়দের তাক করে এই ছোড়াছুড়ির ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটে থাকে ফুটবল অঙ্গনে। এই ছোড়াছুড়িতে সমর্থকদের কলার প্রতি প্রীতিটা লক্ষণীয়। আবার কলার আঘাতে ছলাকলা না দেখিয়ে উল্টো সেই কলাকেই ছিলে দু কামড় বসিয়ে দেওয়ার নজিরও আছে। দানি আলভেজ! মনে পড়ে? ২০১২ সালে লা লিগায় ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে বার্সেলোনার তখনকার এই রাইটব্যাককে কলা ছুড়ে মেরেছিলেন স্বাগতিক সমর্থকেরা। আলভেজ করলেন কী, কলাটা মাটি থেকে কুড়িয়ে তা ছিলে দু কামড় বসিয়ে দেন। সমর্থকদের এই ‘বর্ণবাদী’ আচরণের জন্য ভিয়ারিয়ালকে জরিমানা গুনতে হলেও আলভেজের জবাবটা কিন্তু মোক্ষম ছিল।

চেলসি সমর্থকদের শাক-সবজি প্রীতি তো প্রায় তিন দশকের ঐতিহ্য (!)। মাঠে তাঁরা বেশ কয়বার তা ছুড়ে মেরেছে। ২০০৭ সালে টটেনহামের এক খেলোয়াড়ের ওপর ‘সেলেরি’ছুড়ে মেরে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিন ‘ব্লুজ’ সমর্থক। সেই বছরই একই সবজির আঘাতের শিকার হন সেস্ক ফ্র্যাব্রিগাস। স্প্যানিশ মিডফিল্ডার তখন আর্সেনালের। আসলে ইংলিশ ফুটবলে এই বছরটাই ছিল বোধ হয় শাক-সবজি ছুড়ে মারার! শুধু চেলসি নয়, ২০০৭—কে এভাবে মনে রাখতে বাধ্য করেছেন আসলে ওয়াটফোর্ড সমর্থকেরা। মাঠের নিরাপত্তাব্যূহ ফাঁকি দিয়ে তাঁরা প্রায়ই শাক-সবজি আর ফল-মূল নিয়ে ঢুকতেন গ্যালারিতে। যেমন রিডিংয়ের মাঠে এক ম্যাচে আলোকচিত্রীরা আবিষ্কার করলেন গ্যালারিতে পড়ে আছে তরমুজ, বাটারনাট স্কোয়াশ (লাউয়ের মতো সবজি বিশেষ), আদা, গাজর, নানা পদের লেবু, ব্রোকোলি আর বেগুন।

গ্যালারিতে সবজি আর ফলমূলের এই ক্ষণস্থায়ী ‘বাজার’ বসানোর কারণটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না।