কোথায় ছিলেন এই ইমরুল!

বাবা হওয়ার উদ্‌যাপন দুর্দান্ত এক ইনিংসে করলেন ইমরুল। ছবি: শামসুল হক
বাবা হওয়ার উদ্‌যাপন দুর্দান্ত এক ইনিংসে করলেন ইমরুল। ছবি: শামসুল হক
>জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। ৬৬ রানে ৩ উইকেট আর ১৩৯ রানে ৬ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে দুবারই টেনে তুলেছেন ইমরুল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ বছর কাটিয়ে দেওয়া অভিজ্ঞ ওপেনার তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো সব আলো কেড়ে নিলেন নিজের দিকে।

এই উদ্‌যাপনটা অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত হয়ে আছে বেবেতোর সৌজন্যে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে গোল করে সন্তানকে অভিনব কায়দায় উৎসর্গ করেছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার। ইমরুল কায়েস ব্যাটসম্যান। তিনি গোল করতে পারেন না, তবে সেঞ্চুরি তো করতে পারেন। আজ সেঞ্চুরি করে তাঁর উদ্‌যাপনটা হলো বেবেতোর মতোই। ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়ে ব্যাটটা হাতে নিয়ে দোলাতে থাকলেন। মোবাইলের আলো জ্বেলে ইমরুলকে অভিনন্দন জানাল দর্শকেরা। আজ সব আলো তো ইমরুলকেই ঘিরে!

নয় মাস পর ‘হোম অব ক্রিকেটে’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে। সেটিকে অভ্যর্থনা জানাতে দর্শকদের আগ্রহের কমতি নেই! হেমন্তের নরম বিকেলে আয়েশ করে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের হতাশ করেছেন বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যাটসম্যান। ব্যতিক্রম শুধু ইমরুল কায়েস। বাঁহাতি ওপেনার নাকি নিজের দিকে সব আলো কেড়ে নিতে পারেন না। আজ অন্তত এটি বলার উপায় নেই। তাঁর ১৪৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটা বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮ উইকেটে ২৭১ রানের স্কোর।
ইমরুল প্রায়ই নিজেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ‘দুর্ভাগা ক্রিকেটার’ হিসেবে দাবি করেন। তিনি যেন ‘দুয়োরানির ছেলে’! বর্তমান দলে যে ছয়জন খেলোয়াড়ের ১০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা আছে, ইমরুল তাঁদের একজন। বাকি পাঁচজন দেশের ক্রিকেটে বড় তারকা হলেও ইমরুলের ভাগ্যে তারকা তকমা জোটেনি। না জুটুক, তাতে তাঁর আপত্তি নেই। বাঁহাতি ওপেনারের চাওয়া একটাই—দলে নিয়মিত হওয়া। ১০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাটিয়ে দেওয়ার পরও দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয়! অথচ পরিসংখ্যান তাঁর পক্ষেই কথা বলে। ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ১৮ ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেয়েছেন, গড় ৪৭.২৫। এই সময়ে খেলা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে গড়ে তাঁর ওপরে শুধু আছেন তামিম ইকবাল (৬১.৬৪)। তবুও প্রায় প্রতিটি সিরিজে বা টুর্নামেন্টে দলে থাকতে তাঁকে যথেষ্ট কাঠখড় পোহাতে হয়।

তাতে ইমরুলেরও দায় আছে। অন্তত ওয়ানডে দলে তাঁর ব্যাটে দ্যুতি যেন সেভাবে ছড়ায় না। টেস্ট ওপেনারের তকমাটা যে ছিঁড়ে ফেলে দেবেন, সেই রকম ইনিংসও খুব বেশি খেলা হয়নি। বাবা হওয়া নাকি একজন পুরুষকে বদলে দেয়। পুরুষ দায়িত্বে অভিভাবক হয়ে ওঠে। আজ দুই দুইবার ভীষণ বিপদে পড়ে যাওয়া, সাকিব-তামিমবিহীন বাংলাদেশকে সেই অভিভাবকত্বই শুধু করলেন না, ইমরুল খেললেন নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার এক ইনিংস। ১৩ চার ও ৫ ছক্কার ইনিংসটা ঠিক পরিসংখ্যানে বোঝা যাবে না। আজ যা করতে চেয়েছে, ইমরুল ঠিক তা-ই করেছেন। যেন রাজদণ্ড হাতে নিয়ে শাসন করছেন কোনো রাজা!

এই ইনিংসটাই ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ইমরুলের মোড় ঘুরিয়ে দেয় কি না, সেটাই এখন দেখার। সবশেষ এশিয়া কাপের দলেও আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়েছিলেন। সেদিন অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংস খেলার পরও আবার কিছুটা নড়বড়ে দেখাচ্ছিল। কিন্তু আজ যেন অন্য এক ইমরুলকে দেখা গেল। কী প্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসে ফুটন্ত! এত দিন কোথায় ছিলেন এই ইমরুল!
ইমরুলের মনে আরও প্রশান্তি এনে দিয়েছে তাঁর নবজাতক সন্তান। ঘরে নতুন অতিথি আসার পর খেলতে নেমেছেন প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। আর সেটিতেই সেঞ্চুরি। যেনতেন সেঞ্চুরি নয়, দলকে বাঁচানো সেঞ্চুরি। এই সেঞ্চুরি উদ্‌যাপনে থাকল ইমরুল-পুত্র।

সতীর্থ ব্যাটসম্যানরা যখন ব্যাটের কানায় লেগে উইকেটকিপার ব্রেন্ডন টেলরের গ্লাভসবন্দী হচ্ছেন ইমরুল তখন স্বচ্ছন্দে এগিয়ে গেছেন। কখনো পেছনের পায়ে পাঞ্চ করে কাভার দিয়ে বাউন্ডারি তো, সামনের পায়ে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে দৃষ্টিগ্রাহী ছক্কা। আবার সেই ইমরুলই শৌর্যের প্রতীক হয়ে পুল, স্লগ সুইপ কিংবা রিভার্স সুইপে বাউন্ডারি মারছেন। প্রিয় ফ্লিকে যদিও বেশি রান তুলেছেন। ভুল বলতে পঞ্চম ওভারের শেষ বলে ত্রিপানোকে ফ্লিক করতে গিয়ে স্কয়ার লেগে বাউন্ডারির সীমানার কাছে অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন (৭ রানে)।

শক্তির জায়গা লেগ সাইডেই বেশি খেলেছেন, সেঞ্চুরির প্রায় ৬৮ শতাংশ এসেছে অনসাইড থেকে। তিন অঙ্ক ছুঁয়েই ইমরুলের ব্যাট হয়ে উঠেছে আরও ধারালো। প্রায় ৮৫ স্ট্রাইক রেট তাই ইনিংস শেষে হয়ে গেল ১০২.৮৫। সেঞ্চুরির পর করা ৪৪ রান করেছেন মাত্র ২২ বলে। এই ৪৪ রানের ৩৪ এসেছে বাউন্ডারি থেকে। জার্ভিসকে যখন কাভার দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে মুরের ক্যাচ হলেন, ইমরুল করে ফেলেছেন নিজের ক্যারিয়ারে তো বটেই, ওয়ানডেতে দেশের মাঠে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানটাও।

আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত ছয় সতীর্থের সঙ্গেই জুটি গড়ার চেষ্টা করেছেন। তৃতীয় উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে ৪৯ রানের পর ৭১ রানের জুটি হয়েছে মোহাম্মদ মিঠুনের সঙ্গে। তবে ১৩৯ রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর সবচেয়ে কার্যকরী জুটিটা হয়েছে সপ্তম উইকেটে। ইমরুল-সাইফউদ্দিনের ১১৫ বলে রেকর্ড ১২৭ রানের জুটি বাংলাদেশকে আজ উদ্ধার করেছে।

সেঞ্চুরি নিয়ে ইমরুলের একটা দুঃখ আছে। ওয়ানডেতে আগে যে দুটি সেঞ্চুরি করেছেন (নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে), দুটিই বৃথা গেছে! সেঞ্চুরির পরও দল হেরেছে। আজ বৃথা গেলে ইমরুলের দুঃখের শেষ থাকবে না! মাশরাফিরা নিশ্চয়ই এত সুন্দর একটা ইনিংস বৃথা যেতে দেবেন না।