মেহেদীর 'মেহনতি' হাত হয়ে উঠুক বাংলাদেশের হাতিয়ার

অনূর্ধ্ব ১৫ সাফ জয়ের নায়ক মেহেদি হাসান। সংগৃহীত ছবি
অনূর্ধ্ব ১৫ সাফ জয়ের নায়ক মেহেদি হাসান। সংগৃহীত ছবি
>গোলরক্ষক মেহেদী হাসান ছিল সোনার দোকানের কর্মচারী। দুই বছরের ব্যবধানে তার বিশ্বস্ত হাতের ওপর ভর করেই অনূর্ধ্ব–১৫ সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ

ঘুম থেকে উঠে পেটে কিছু দানা-পানি দিয়েই দোকানের তালা খুলে ঝাড়পোঁছ দিয়ে আসন গেড়ে বসা। হিটার ল্যাম্পে আগুন জ্বালাও, রুপা দিয়ে ঝালাই আংটি তৈরি করো, গাঁথো চেইন। একটা জুয়েলারি দোকানের ছোট এক কর্মচারীর প্রতিদিনের জীবনটা ছিল খটখট শব্দের মধ্যে এমনই গৎবাঁধা। খুব বেশি দিন আগের নয়, ২০১৬ সালের কথা।

দুই বছর আগের সেই জুয়েলারি শ্রমিকই আজকের মেহেদী হাসান, যার বিশ্বস্ত হাতের ওপর ভর করেই অনূর্ধ্ব–১৫ কিশোর সাফ শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ। যশোরের এই ছেলের কাছেই নেপালের মাটিতে বধ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে টাইব্রেকার শট ঠেকিয়েছে দুটি। আর ফাইনালে বদলি নেমে পাকিস্তানের বিপক্ষে টাইব্রেকার শট ঠেকিয়েছে তিনটি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুটি ম্যাচে পাঁচটি টাইব্রেকার শট ঠেকিয়ে দেওয়া। ভাবা যায়! আসলে মেহেদীর হাত তো শ্রমিকের মেহনতি হাত!

গৃহিণী স্ত্রী, দুই মেয়ে ও মেহেদীকে নিয়ে মিজানুর রহমানের টানাটানির সংসার। বাসের কন্ডাক্টরি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না। এর মধ্যে বড় ছেলে মেহেদীর পড়াশোনায় মন নেই। খালি ফুটবল আর ফুটবল। ব্যস, রাগ করে ২০১৫ সালে মেহেদীকে দিয়ে দিলেন সোনার দোকানের কাজে। ছেলে আংটি বানানো শেখে, হিটার ল্যাম্পে আগুন জ্বালানোতে সিদ্ধহস্ত হয়। কিন্তু ওই আগুনেই তো ভেতরে পুড়তে পুড়তে খাঁটি হয় ফুটবলার হওয়ার বাসনা। সোনার দোকানে কাজ করার সুবাদেই সুযোগটা বুঝি এসে গেল।

বেনাপোল বাজার সমিতির খেলায় মেহেদী দাঁড়িয়ে গেল জুয়েলারি দোকানিদের নিয়ে গড়া দলের গোল পোস্টের নিচে। ম্যাচটি শৌখিন হলেও বদ্ধ ঘরে আটকে থাকা পাখি হঠাৎ ছাড়া পেয়ে উড়তে চাইল ডানা মেলে। মাঠে উপস্থিত থাকায় ‘সোনা’ পেয়ে গেলেন বেনাপোলের নুর ইসলাম একাডেমির কোচ সাব্বির পলাশ। জাতীয় দলের সাবেক এই ফুটবলার বুঝে গেলেন, সোনার দোকানের এই কর্মচারীই পারবে বাংলাদেশকে সোনা এনে দিতে।

কিন্তু এর আগে তো প্রয়োজন মেহেদীকে সোনার দোকান থেকে বের করে আনা। তাই মেহেদীকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবার কাছে গিয়ে আরজি জানালেন পলাশ, ‘আপনার ছেলেটাকে আমাকে দিন ভাই। দুই বছরের মধ্যে ও কিছু করতে না পারলে তার দায় আমি নেব।’ আসলে পলাশই খাঁটি জহুরি। আসল সোনা চিনতে তাঁর কষ্ট হয়নি। তাঁর শিষ্য মেহেদীর নিজেকে চেনাতে দুই বছরের বেশিও লাগেনি। ২০১৬ সালে মাঠে যাওয়া শুরু, ২০১৮–এর নভেম্বরে জ্বলে ওঠা। এর আগে নুর ইসলাম একাডেমির হয়ে শেষ পাইওনিয়ার ফুটবলেও সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার উঠেছিল মেহেদীর হাতে।

কিন্তু কীভাবে স্পটকিক ঠেকানোর মতো দুরূহ কৌশল আয়ত্তে আনা?

নুর ইসলাম একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম লিটনের সঙ্গে কোচ সাব্বির পলাশ। সংগৃহীত ছবি
নুর ইসলাম একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম লিটনের সঙ্গে কোচ সাব্বির পলাশ। সংগৃহীত ছবি

একাডেমি থেকেই শেখার শুরু। এরপর জাতীয় দলের ক্যাম্পে এসে গোলরক্ষক কোচ মিনারুল ইসলামের কাছে এসে হাত পাকা হওয়া। সোমবার বাফুফে ভবনে দাঁড়িয়ে শোনাচ্ছিল মেহেদী, ‘একাডেমি না থাকলে সোনার দোকানেই হয়তো চাকরি করতে হতো। আমার জীবনটা বদলে দিয়েছেন পলাশ স্যার। ওনার কাছ থেকেই শেখার শুরু। আর জাতীয় দলের ক্যাম্পে এসে মিনার স্যার খুব ভালো শিখিয়েছেন—স্পটকিকের সময় খেলোয়াড়ের পায়ের কোন দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

জাতীয় দলের সাবেক গোলরক্ষক আমিনুল হকের ভক্ত মেহেদীর মুখে বারবার উঠে এল তার একাডেমি ও কোচ পলাশের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ। কথা হলো কয়লা থেকে সোনা তুলে আনা কোচ পলাশের সঙ্গে। দীর্ঘদিন আমিনুলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে খেলেছেন। তাই আমিনুলের  ক্যারিশমাটা তাঁর ভালোই জানা। মেহেদিকে হাতে পাওয়ার পর থেকেই চেয়েছিলেন দেশকে একটা আমিনুল উপহার দেওয়ার, ‘আমি প্রায় ছয় বছর আমিনুলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধায় খেলেছি। ও-ই আমার চোখে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা গোলরক্ষক। দেশকে আরেকটা আমিনুল উপহার দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই হাতে তুলে নিয়েছি মেহেদীকে।’

আমিনুলের মতো হতে পারবে কি না মেহেদি, এটা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এক জায়গায় কিছুটা হলেও আমিনুলকে ছুঁতে পেরেছে বেনাপোলের ছেলে। ২০০৩ সাফ ফুটবলে মালদ্বীপের বিপক্ষে টাইব্রেকার ঠেকিয়ে বাংলাদেশকে শিরোপা জিতিয়ে ছিলেন আমিনুল। আর মেহেদি টাইব্রেকার ঠেকিয়ে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে কিশোর সাফ শিরোপা। সিনিয়র সাফ ও কিশোর সাফের মধ্যে পার্থক্যটা আকাশ আর পাতাল। কিন্তু সকাল দেখেই তো দিনের আন্দাজ করা যায়।

মেহেদীর হাতের কারুকাজে একসময় ফুটে উঠত সোনার বাহারি অলংকার। এখন আর তা না হলেও ছেলেটি কিন্তু নিপুণ হাতে অলংকার আঁকছে। বদ্ধ ওই ঘরের জায়গায় তা সবুজ ক্যানভাসে।