লিখেই ফেললাম, মুমিনুল

টেস্টে তৃতীয়বারের মতো দেড় শ ছাড়ানো ইনিংসে দারুণ সব শট খেলেছেন মুমিনুল। ছবি: প্রথম আলো
টেস্টে তৃতীয়বারের মতো দেড় শ ছাড়ানো ইনিংসে দারুণ সব শট খেলেছেন মুমিনুল। ছবি: প্রথম আলো

—এই টেস্টে একটা সেঞ্চুরি করে ফেলেন।

মুমিনুল হক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

দার্শনিকসুলভ এক নির্লিপ্ততাকে ট্রেডমার্ক বানিয়ে ফেলেছেন অনেক দিনই। নাকি জন্মগতভাবেই এটি পাওয়া! মুখ দেখে তাঁর মনের ভাব খুব কমই বোঝা যায়। ‘টেস্ট সেঞ্চুরি যেন ছেলের হাতের মোয়া, চাইলেই করে ফেলা যায়’—মনে মনে এমন কিছু বলে থাকলেও যথারীতি তা বোঝার উপায় থাকল না।

সেঞ্চুরির ‘ফরমাশ’ বলুন বা ‘আবদার’—তা করার কারণটা মুমিনুলকে বুঝিয়ে বললাম। এই টেস্টে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান প্রথম যে সেঞ্চুরিটি করবেন, সেটি হয়ে যাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে এক শ নম্বর সেঞ্চুরি।

মুখের একটা রেখাও কাঁপল না মুমিনুলের। নির্বিকার জবাব এল, ‘সেঞ্চুরির কথা ভাবলে ম্যাচ জেতা যায় না।’

‘কেন, সেঞ্চুরি করলে কি ম্যাচ জেতাটা সহজ হয়ে যায় না?’

 মুমিনুলের মুখ একইরকম নিরাসক্ত, ‘উল্টা। ম্যাচ জেতার কথা ভেবে খেললে বরং সেঞ্চুরি করাটা সহজ হয়ে যায়।’

তাৎক্ষণিকভাবে এমন একটা উত্তর একটু চমকেই দিল। সেই চমকের ঘোর কাটার আগেই মুমিনুল বললেন, ‘আমি জানি, একদিন আপনি এটা লিখবেন।’

জবাব দিলাম, ‘আমি তো আজই লিখতে চাই।’

মুমিনুল মৃদু হাসলেন।

‘আজ’ মানে সেদিন অবশ্য আর লেখা হলো না। মুমিনুলের সঙ্গে এই কথোপকথন সিলেটে অভিষেক টেস্ট শুরুর দিন সকালে। টিম হোটেলের ব্রেকফাস্ট রুমে। টেস্টের প্রথম দিনটাই শুধু সিলেটে ছিলাম। টসে জিতে জিম্বাবুয়ে ব্যাটিং নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিত হয়ে গেছে, বাংলাদেশের এক শ নম্বর এক শটা আজ হচ্ছে না। ওই টেস্টেই যে আর হবে না, সেটি তখন ভাবতেও পারিনি।

সেই সেঞ্চুরি হলো মিরপুরে। সিলেটে হয়ে গেলে সেটি মাঠে বসে দেখা হতো না। নানা তালেগোলে দেখা হলো না মিরপুরে হওয়ার পরও। বাংলাদেশের এক শতম এক শটা দেখলাম টেলিভিশনে। বরাবরই প্রেসবক্সে হাততালি দেওয়ার ঘোর বিরোধী। বাসায় তো আর সেই সমস্যা নেই। হাততালি দিয়ে মুমিনুলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, আর মনে পড়ছে সিলেটের সেই সকাল। মুমিনুলের সেই বাণীও—ম্যাচ জেতার কথা ভেবে খেললে সেঞ্চুরি করাটা সহজ হয়ে যায়।

মুমিনুলের এই সেঞ্চুরিও তাহলে ম্যাচ জেতার কথা ভেবে খেলার বাই–প্রোডাক্ট! মিরপুরের এই টেস্টে অবশ্য অন্য কিছু ভেবে খেলার কোনো সুযোগই ছিল না বা এখনো নেই। এই টেস্টে না জিতলে তো মহা কেলেঙ্কারি। একটা সময় জিম্বাবুয়েও ছিল বাংলাদেশের কাছে প্রবল এক প্রতিপক্ষ। সেই দিন এমনই বদলে গেছে যে, জিম্বাবুয়ের কাছে সিরিজ হারের সম্ভাবনা এখন অকল্পনীয় এক কলঙ্কের রূপ নিয়ে মুখ ব্যাদান করে তাকায়। দেশের মাটিতে খেলা বলে আরও বেশি। এই সমীকরণ মাথায় নিয়ে কাল সাতসকালে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে ২৬।

দলের কথা ভেবে খেললে নিজেরটা এমনিতেই হয়ে যায়—মুমিনুলের এই দর্শন তো জেনেই গেছেন। এখানে কোনোটার চেয়ে কোনোটার প্রয়োজন কম ছিল না। গত ৪ টেস্টের ৮ ইনিংসে তিনটি শূন্য, সব মিলিয়ে রান মাত্র ৬৯। সেটিও একটা ইনিংসে ৩৩ করেছিলেন বলে। মুমিনুলের ছোট্ট দুই কাঁধে কী চাপটাই না ছিল!

এই ‘চাপ’ অবশ্য অনেক দিনই তাঁর ছায়াসঙ্গী। যেদিন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তাঁর ওয়ানডে খেলার সামর্থ্যের পাশে বড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিলেন, সেদিন থেকেই। বাংলাদেশের মতো ওয়ানডে–পাগল দেশে গায়ে ‘টেস্ট স্পেশালিস্ট’ তকমাটা আনন্দের তো নয়ই, খুব একটা গৌরবও বোধ হয় বহন করে না। টেস্ট ব্যাটিং এমনিতেই কঠিন, ওয়ানডে খেলতে না পারলে সেটি আরও বেশি কঠিন হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতিতে যাতে জং ধরে যাওয়ার শঙ্কা থাকেই। এভাবেই তো কাটছে মুমিনুলের ক্রিকেট–জীবন। যাঁর কাজটাকে অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ কঠিন করে দিয়েছি আমরাই। 

একেবারেই পাকেচক্রে ওয়ানডেতে ফিরেছেন গত এশিয়া কাপে। সাড়ে তিন বছর পর দুটি ম্যাচে সুযোগ পেয়েছেন, যেগুলোর আগে–পরেও ‘ওয়ানডেতে মুমিনুল চলে না’ কোরাস শোনা গেছে। সেটি দলের ভেতর থেকেই। পরিবেশটা এমন ছিল যে, মুমিনুলের সফল হওয়াটাই হতো অস্বাভাবিক।

ওয়ানডের কথা বাদ দিন, হাথুরুসিংহে তো মুমিনুলের টেস্ট ক্যারিয়ারেরও প্রায় বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট স্কোয়াড থেকে মুমিনুলকে বাদ দেওয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তাঁরই। সংবাদমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার পর সেই সিদ্ধান্ত গিলতে বাধ্য হন। এরপর যা করেন, সেটি কোনো খেলোয়াড়ের প্রতি কোচের বিদ্বেষের উদাহরণ হিসেবে চিরদিন আলোচিত হওয়া উচিত। ঢাকায় প্রথম টেস্টে বসিয়ে রাখার পর চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে মুমিনুলকে নামান ৮ নম্বরে!

নিয়তির কী অদ্ভুত খেলা, বাংলাদেশ ছাড়ার কিছুদিন পর সেই হাথুরুসিংহে যখন শ্রীলঙ্কা দলকে নিয়ে সফরে এলেন, সেই চট্টগ্রামেই টেস্টের দুই ইনিংসে মুমিনুলের সেঞ্চুরি! বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান কখনো যা পারেননি, আটে নামানোর সেই অপমানের পর হাথুরুর সঙ্গে প্রথম দেখাতেই সেই কীর্তি! সেটিও সেই মাঠেই। একটু কল্পগল্পের মতো তো লাগেই।

মুমিনুলের ওপর দিয়ে যে ঝড় গেছে, বাংলাদেশের অন্য অনেক ক্রিকেটার এসবের মধ্য দিয়ে গেলে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতেন। মুমিনুল অন্য ধাতুতে গড়া বলেই টিকে আছেন। মনে নিশ্চয়ই ঝড় উঠেছে, কিন্তু এসব নিয়ে প্রকাশ্যে কখনো অভিযোগ পর্যন্ত করেননি।

সেই মুমিনুলের ব্যাটে বাংলাদেশের এক শ নম্বর এক শ। এর চেয়েও বেশি প্রতীকী হয়ে যেটি আবার টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ৫০তম সেঞ্চুরি। ভালোই হয়েছে, টেস্টে মাইলফলক সেঞ্চুরিটা ‘টেস্ট ব্যাটসম্যান’–এর ব্যাটেই তো ভালো মানায়!