পরিশ্রম, পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তি...

জাতীয় দলের জার্সিতে বিপ্লব। প্রথম আলো ফাইল ছবি
জাতীয় দলের জার্সিতে বিপ্লব। প্রথম আলো ফাইল ছবি

‘দাদা, এত তাড়া কিসের?’

জার্সি-প্যান্ট-বুট পরে গ্লাভসজোড়া হাতে নিয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সিঁড়ি বেয়ে হুড় হুড় করে মানুষটিকে নেমে আসতে দেখে মুখ ফসকে বের হয়ে গেল প্রশ্নটি। কালক্ষেপণ না করে (জোরে হাঁটতে হাঁটতে) বললেন, ‘ওপরে আমার রুমে গিয়ে বসো। ওয়ার্মআপ সেশনটা শেষ করে আসি।’

৪০ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে দাঁড়িয়ে একটা অনুশীলন সেশনের জন্য এত তাড়া বিপ্লব ভট্টাচার্যের। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই গোলরক্ষকের বীরত্বেই ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসের সোনা জয় করেছিল জাতীয় দল। এরপর ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যও। পরবর্তী সময়ে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন দীর্ঘদিন (২০১৩ সাল পর্যন্ত)। ১৯৯৯ থেকে ২০১৩—টানা আটটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে অনন্য রেকর্ডও আছে। জাতীয় দলের পাট চুকে গেলেও ৪০ বছর বয়সেও ঘরোয়া ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে এখনো খেলে যাচ্ছেন দিব্যি।

এই সাফল্যের রহস্য কী?

বিপ্লবের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের জাতীয় দলে খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল। সে সূত্রে কিছুটা জানা আছে। কিন্তু সে–ও অনেক আগের কথা। এখনো কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখেন বিপ্লব, সেটা জানার জন্যই গোপীবাগের ব্রাদার্স ক্লাবে ঢুঁ মারা। সাফল্যের রেসিপিটা দেখা হলো স্বচক্ষে। ক্লাবসংলগ্ন মাঠ থেকে আধা ঘণ্টার ওয়ার্মআপ সেশন শেষ করে রুমে ফিরে খাটের তলা থেকে বের করে আনলেন ১০ কেজির মেডিসিন বল। এরপর খাটের ওপর বসে, আধশোয়া হয়ে আবার কখনো ফ্লোরে হেঁটে হেঁটে চলল পেশি ও কোমরে শক্তি বাড়ানোর অনুশীলন।

দাদা, এই বয়সেও মেডিসিন বল? আবারও মুখ ফসকে বের হয়ে যেতেই বিপ্লবের পাল্টা জবাব, ‘তোরা শুধু আমার বয়সটা দেখিস!’

আসলেই নিজেকে সর্বোচ্চ ফিট রাখার আশায় যে মানুষটি অনুশীলন শেষ করে রুমে ফিরেও কঠোর অনুশীলন করে যাচ্ছেন, তাঁর কাছে বয়সটা শুধুই সংখ্যা। এই পরিশ্রমের জোরেই বিপ্লব এখনো ক্লাব দলের এক নম্বর গোলরক্ষক হিসেবে বিবেচিত। ফেডারেশন কাপের গ্রুপ পর্ব থেকে ব্রাদার্স বিদায় নিলেও কখনো মনে হয়নি কমলা জার্সিদের তিন কাঠির নিচে দাঁড়িয়েছেন ৪০ বছর বয়সের কোনো গোলরক্ষক। নিখুঁত গ্রিপিং, সময়মতো পোস্ট ছেড়ে বের হয়ে আসা, রিফ্লেক্স—সব মিলিয়ে এখনো দুর্দান্ত।

১৯৯৩ সালে দীপালি যুব সংঘের জার্সিতে তৃতীয় বিভাগ দিয়ে ঢাকার ফুটবলে বিপ্লবের আগমন। পরের বছরই তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে বিপ্লবকে দলে টানে আবাহনী। ওই বছর খেলার সুযোগ হয়েছিল কেবল একটি ম্যাচ। ৯৫ সালে দলের এক নম্বর গোলরক্ষক খারাপ খেলায় বদলি হিসেবে নামানো হয় বিপ্লবকে। ব্যস, এরপর থেকেই চাকাটা চলছে। ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ আট মৌসুম খেলেছেন তাঁর প্রিয় ক্লাব আবাহনী লিমিটেডের জার্সিতে, শেখ রাসেলে পাঁচ বছর। ঘরোয়া ফুটবলে এই দুটি ক্লাবের গৌরবান্বিত ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। পেশাদার লিগ চালু হওয়ার পর বিপ্লবের নেতৃত্বেই হ্যাটট্রিক শিরোপা জয় করে আবাহনী। ২০১২-১৩ মৌসুমে শেখ রাসেলের ট্রেবল জয়ের অন্যতম নায়কও তিনি। এ ছাড়া আছে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে লিগ জয়ের অভিজ্ঞতা।

জাতীয় দলের ক্যারিয়ারটা তো আরও বর্ণিল। আবাহনীতে খেলা অবস্থাতেই ১৯৯৬ সালে অটো ফিস্টারের অনূর্ধ্ব–১৬ জাতীয় দলে ডাক পাওয়া। পরের বছরই এই জার্মান কোচের হাত ধরে জাতীয় দলে অভিষেক হয় সৌদি আরবের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে। জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ম্যাচটিতে বাংলাদেশ ৩-০ গোলে হারলেও শুরুর ১০ মিনিটে স্বাগতিক অধিনায়কের নেওয়া পেনাল্টি ঠেকিয়ে আগমনী বার্তা দেওয়া। ১৯৯৯ সাফ গেমসের কীর্তি তো সবারই জানা। সোনার হরিণ হয়ে যাওয়া সাফ গেমসের স্বর্ণ বাংলাদেশের হাতে প্রথম ধরা দেয় কাঠমান্ডুতে। ফাইনালে বাংলাদেশের গোল পোস্টের নিচে বিপ্লব ছিলেন অসাধারণ। সেমিফাইনালে ভারত বধের নায়কও তিনি। তাই ওই দুটি ম্যাচকেই ক্যারিয়ারের সেরা হিসেবে রায় তাঁর, ‘আমার জীবনের সেরা খেলেছি কাঠমান্ডুতে নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে ও সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে।’

নতুন প্রজন্মের সঙ্গে বিপ্লব। প্রথম আলো ফাইল ছবি
নতুন প্রজন্মের সঙ্গে বিপ্লব। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের আরেক সাফল্য ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়ন দলেও ছিলেন। কিন্তু আমিনুল হকের জন্য সেবার মাত্র একটি ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। এ ছাড়া পরবর্তী সময়েও আমিনুলের ছায়ায় থাকতে হয়েছে তাঁকে। কেউ কারও চেয়ে কম না হওয়ায় জাতীয় দলে দুজনের প্রতিযোগিতা ছিল তুঙ্গে। ২০১১ পর্যন্ত জাতীয় দলে চলেছে আমিনুল-রাজ। বন্ধুর অবসরের পর বিপ্লব কিছুদিন ছিলেন এক নম্বর গোলরক্ষক। নিজেদের শক্তিমত্তাকে ১৯-২০ বলে মনে করেন বিপ্লব, ‘আমিনুল অনেক উঁচুমানের গোলরক্ষক ছিল। তবে কখনো ওর ছায়ায় ছিলাম না। আমরা দুজন ১৯-২০ ছিলাম। নিজেদের মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। যখন যে সুযোগ পেয়েছি, তখন সে–ই প্রমাণ করেছি।’

২০১১ সালের জুলাইয়ে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় লেবাননের সঙ্গে সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছেন। এরপর শেষবারের মতো ২০১৩ সালের সাফে দলে থাকলেও খেলা হয়নি। আনুষ্ঠানিক অবসর নিতে পারেননি বলে ডাচ্‌ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফের ওপর একটু আক্ষেপ তাঁর রয়েই গেছে, ‘ফুটবল থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কোনো অতৃপ্তি নেই। কিন্তু জাতীয় দল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিতে পারলাম না। এই আফসোসটা রয়েই গিয়েছে।’

ঘরোয়া ফুটবল থেকে গত বছরই অবসর নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফুটবলের প্রতি ছোট মেয়ের ভালোবাসা দেখে সিদ্ধান্ত বদল, ‘আমার ছেলে কৃষ তাঁর ফুটবলার বাবাকে চেনে। কিন্তু দুই বছরের মেয়ে স্পর্শ চেনে না। দেখলাম, মেয়েটা বাসায় ফুটবল নিয়ে অনেক খেলে। তাই মেয়ের জন্যই চালিয়ে যাওয়া।’ ইমোতে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানালেন বিপ্লব।

কিন্তু ৪০ বছর বয়সেও কীভাবে সম্ভব? চালিয়ে যেতে চাই বললেই তো চালিয়ে যাওয়া যায় না। শুধু পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তিকেই নিজের চালিকা শক্তি মানেন বিপ্লব, ‘আমি শুধু খেলে যাচ্ছি পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তির জোরে।’ আরও একজন অলক্ষ্যে বিপ্লবকে অনুপ্রেরণা দেন—ইতালির গোলরক্ষক বুফন। ৪০ বছর বয়সে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।

বিপ্লবের জিজ্ঞাসা—‘বুফন পারলে আমি কেন পারব না?’