আর্জেন্টিনার ফুটবলের কুৎসিত দিক

এ গ্যালারিটা কাল দর্শকে পরিপূর্ণ থাকার কথা ছিল। ছবি: রয়টার্স
এ গ্যালারিটা কাল দর্শকে পরিপূর্ণ থাকার কথা ছিল। ছবি: রয়টার্স
>বোকা জুনিয়র্সের খেলোয়াড়দের ওপর রিভার প্লেট সমর্থকদের হামলার কারণে কোপা লিবার্তোদোরেস ফাইনালের দ্বিতীয় লেগটা মাঠেই গড়াতে পারল না। ফলে আরেকবার বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল আর্জেন্টাইন ফুটবলের কুৎসিত দিক

স্টেডিয়াম তো নয়, যেন রণক্ষেত্র! ফাইনালের আগেই দুই দলের সমর্থকেরা জড়িয়ে পড়লেন সহিংসতায়। প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের ওপর হামলা, সমর্থকদের সঙ্গে হাতাহাতি-মারামারি রূপ নিল রক্তারক্তিতে। ভয়ংকর এ ঘটনা ঘটেছে পরশু আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে। বোকা জুনিয়র্স ও রিভারপ্লেটের মধ্যে কোপা লিবার্তোদোরেসের ফাইনালের দ্বিতীয় লেগকে কেন্দ্র করে। এই ঘটনার পর ম্যাচ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ম্যাচটি আবার কবে হবে সেটা এখনো জানায়নি কর্তৃপক্ষ।

এমনিতেই বোকা-রিভারপ্লেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবল-বিশ্বের সবচেয়ে উগ্র দ্বৈরথগুলোর একটি। সহিংসতার ইতিহাস এত বেশি যে এখন বোকা জুনিয়র্সের মাঠে খেলা হলে রিভারপ্লেটের সমর্থকেরা সেটি দেখতে যেতে পারেন না। রিভারপ্লেটের মাঠে খেলা হলে একই ‘নিষেধাজ্ঞা’ প্রযোজ্য হয় বোকা জুনিয়র্স সমর্থকদের ক্ষেত্রে। এই দুই দল কোপা লিবার্তাদোরেসে সর্বশেষ মুখোমুখি হয়েছিল ২০১৫ সালে। পুরো ৯০ মিনিট খেলাই হয়নি মারামারির কারণে!

এমন দুই ক্লাব এবার দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়নস লিগ কোপা লিবার্তোদোরেসের ফাইনালে মুখোমুখি। কোপার ইতিহাসেই এই প্রথম আর্জেন্টিনার দুই ক্লাব ফাইনাল খেলছে। একই শহরের দুই ক্লাব মুখোমুখিও এই প্রথম। বোকার মাঠে প্রথম লেগটা ২-২ ড্র হয়েছিল। রিভারপ্লেটের মাঠে এই ম্যাচ নিয়ে তাই আরও বেশি উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা সামাল দিতে অনেক প্রস্তুতিই নিয়ে রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

মাঠে বল গড়ানোর আগেই রক্তারক্তি কাণ্ড। স্টেডিয়ামে ঢোকার সময়ই বোকার টিম বাসে হামলা করে রিভারপ্লেট সমর্থকেরা। ইট, পাথর, বিয়ারের বোতলসহ হাতের কাছে যে যা পেয়েছে তাই ছুড়ে মেরেছে বাসের দিকে। এতে ভেঙে যায় গাড়ির কাচ। বোকার কোচকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারা হয়। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও বাঁচতে পারেননি অনেক খেলোয়াড়। বাসের গ্লাস ভেঙে অনেকের চোখে-মুখে ঢুকে যায় কাচ। রিভারপ্লেট সমর্থকেরা এরপর মরিচের গুঁড়াও ছুড়ে মারে খেলোয়াড়দের দিকে! খোদ বাস ড্রাইভারই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন আক্রমণে! পরে ক্লাব ম্যানেজার নিজে স্টিয়ারিং ধরে মাঠের ভেতর বাস নিয়ে ঢুকে পড়েন।

ফুটবল ছাপিয়ে বোকা জুনিয়র্স-রিভার প্লেটের মধ্যকার কোপা লিবার্তোদোরেস ফাইনাল আবার সংঘাতের বিজ্ঞাপন হয়ে রইল। ছবি: রয়টার্স
ফুটবল ছাপিয়ে বোকা জুনিয়র্স-রিভার প্লেটের মধ্যকার কোপা লিবার্তোদোরেস ফাইনাল আবার সংঘাতের বিজ্ঞাপন হয়ে রইল। ছবি: রয়টার্স

হামলায় আহত হন বোকার তারকা ফরোয়ার্ড কার্লোস তেভেজ ও অধিনায়ক পাবলো পেরেজসহ অনেকে। এ সময় মাঠের বাইরে থাকা কিছু বোকা সমর্থকের সঙ্গেও মারামারি লেগে যায় রিভারপ্লেট সমর্থকদের। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিলেও খেলার মতো অবস্থায় ছিলেন না বোকার খেলোয়াড়েরা। কয়েকজনকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে, অনেকেই ড্রেসিংরুমে বমি করছিলেন। বছর তিনেক আগের সেই কোপা লিবার্তোদোরেসের ম্যাচে একইভাবে রিভারপ্লেটের খেলোয়াড়দের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন বোকা জুনিয়র্সের সমর্থকেরা, খেলোয়াড় যাতায়াত করার টানেল ফুটো করে 'পেপার স্প্রে' মেরেছিলেন তাদের দিকে লক্ষ্য করে। ধারণা করা হচ্ছে, সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই এবার এই হামলা।

এত কিছুর পরও নাকি বোকাকে খেলতে জোরাজুরি করেছিল দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা কনমেবল। যেটা নিয়ে পরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তেভেজ, ‘কনমেবল যা করেছে, সেটা লজ্জাজনক। আমাদের দুজন খেলোয়াড় হাসপাতালে, অথচ তারা আমাদের খেলার জন্য জোর করছিল। ঘটনাটা যদি বোকা ঘটাত, তাহলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে রিভারপ্লেটের হাতে ট্রফি দিয়ে দেওয়া হতো।’

শেষ পর্যন্ত পরশু আর মাঠে নামতে হয়নি তেভেজদের। দুই ক্লাবের সভাপতির সম্মতিতে পেছানো হয় ম্যাচ। ম্যাচ কবে হবে, এই নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দুই দলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সামনেই বৈঠক করবেন কনমেবলের প্রেসিডেন্ট। তার পর নির্ধারিত হবে নতুন সময়সূচি। জি-টোয়েন্টির সম্মেলন উপলক্ষে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের প্রধানেরা বুয়েনেস এইরেসে গিয়েছেন। ভ্লাদিমির পুতিনের মতো অনেকেরই উপস্থিত থাকার কথা ছিল এ ম্যাচে। কিন্তু সবই ভেস্তে গেছে।

যুগ যুগ ধরে ফুটবলীয় এই দ্বৈরথকে শুধুমাত্র ফুটবলে সীমাবদ্ধ রাখেননি বোকা আর রিভারের সমর্থকেরা। ১৯৬৮ সালে মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে এই দুই দলের খেলা দেখতে গিয়ে স্টেডিয়ামে ৭১ জন সমর্থক প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর কয়েক বছর আগে রিভারের খেলোয়াড়দের দিকে 'পেপার স্প্রে' মারার সেই ঘটনাটা ঘটিয়েছিল বরিস ব্রাভা নামক এক হুলিগান সংগঠন, আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক অঙ্গনেও যাদের ক্ষমতার কথা সুবিদিত। ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে রিকেলমে, বাতিস্তুতা থেকে আইমার—এই ম্যাচ এলে কেউই নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। বুয়েনস এইরেসের ‘ভদ্রপাড়া’র ক্লাব রিভারপ্লেট যুগে যুগে আকৃষ্ট করেছে দামি খেলোয়াড়দের, খেলার ধরন থেকে শুরু করে রিভারের সবকিছুতেই রয়েছে শৌখিনতার ছোঁয়া। ওদিকে আর্জেন্টিনার নিপীড়িত খেটে খাওয়া জনমানুষের ক্লাব বোকা জুনিয়র্স। শহরের প্রান্তিক সম্প্রদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ক্লাবটা। ফলে যুগ যুগ ধরে ধনী-গরিবের চিরায়ত সেই সংঘাতটাই যেন ফুটে ওঠে এই দুই ক্লাবের দ্বৈরথে। কিন্তু ক্রমাগত এই সংঘাতের ফলে বিশ্ববাসীর কাছে আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ফুটবল সম্পর্কে কি বার্তা পৌঁছাচ্ছে, এই দুই দলের সমর্থকেরা কি সেটা একবারও ভেবে দেখেছে?