মাশরাফির রঙে রঙিন এক জয়

মাশরাফিময় এক জয় পেল বাংলাদেশ। ছবি: শামসুল হক
মাশরাফিময় এক জয় পেল বাংলাদেশ। ছবি: শামসুল হক
>

১৭ বছর সময়টাও যে কারণে নতুন মহিমা নিয়ে দেখা দেয়। কত ঘাম, কত রক্ত, অসহ্য ব্যথায় কাতর কত দিবস–রজনীর গল্প লুকিয়ে এই দীর্ঘ পথযাত্রায়। সব জয় করে মাইলফলক ছোঁয়ার ম্যাচেও যথারীতি সেই বিজয়ী মাশরাফি!

২০০১ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম থেকে ২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম। মাঝখানে ১৭ বছর ১৫ দিন।
ওয়ানডে অভিষেকের ১৭ বছর ১৫ দিন পর ২০০তম ওয়ানডে খেলতে নামলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ১৭ বছরে মাত্র ২০০ ওয়ানডে! কম হয়ে গেল না! নাকি বলবেন, বেশি? মাশরাফির দুই হাঁটুর ওপর দিয়ে যা গেছে, তাতে তাঁর ২০০ ওয়ানডে খেলাটাই তো এক ক্রিকেটীয় রূপকথা! ১৭ বছর সময়টাও যে কারণে নতুন মহিমা নিয়ে দেখা দেয়। কত ঘাম, কত রক্ত, অসহ্য ব্যথায় কাতর কত দিবস–রজনীর গল্প লুকিয়ে এই দীর্ঘ পথযাত্রায়। সব জয় করে মাইলফলক ছোঁয়ার ম্যাচেও যথারীতি সেই বিজয়ী মাশরাফি!

এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের ২০০তম ম্যাচের মাইলফলক ছোঁয়া। উদ্‌যাপন করার মতোই এক উপলক্ষ। সেটির জন্য অন্য কারও অপেক্ষায় থাকলেন না। নিজের পাণ্ডুলিপি নিজেই লেখার পুরোনো অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে হাতে ম্যাচসেরার ট্রফি। সঙ্গে অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বড় চাওয়া অনায়াস জয়ও।

গত কিছুদিন খেলার চেয়ে রাজনীতির কারণেই বেশি আলোচিত হয়েছে মাশরাফির নাম। জীবনে প্রথমবারের মতো শুনতে হয়েছে অনেক কটূক্তিও। খেলতে নামার প্রস্তুতিটাও তাঁর অন্য দশজনের মতো নয়, সেটি প্রায় যুদ্ধযাত্রার মতো। নতুন জীবন শুরু করার টানাপোড়েনে সেটিতেও একটু ব্যাঘাত তো ঘটেছিলই। পেছনে আবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ সিরিজে প্রশ্নবিদ্ধ পারফর‍ম্যান্স—১৬০ রান দিয়ে মাত্র ১ উইকেট। মাথায় এত সব বোঝা নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন বলেই দুই বছর পর জেতা ম্যান অব দ্য ম্যাচ ট্রফিটা পেয়ে যাচ্ছে ভিন্ন এক মাত্রা।

৩০ রান দিয়ে মাশরাফির ৩ উইকেট। ৫ রান বেশি দিয়ে মোস্তাফিজুরেরও তা-ই। যার শেষ দুটি ইনিংসের শেষ ওভারে। দুটিই টেলএন্ডারের। তুলনায় মাশরাফির তিন শিকারই জেনুইন ব্যাটসম্যান। ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৯৫ রানের বেশি করতে না পারায় তাঁর ভূমিকাই বেশি। না বললেও চলত। মাশরাফির ভূমিকা বেশি বলেই তো তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের ঢিমেতালে এগোনোয় ভূমিকা আছে গতিতে ধীর, বাউন্সে অসমান উইকেটেরও। যেটিতে যথেচ্ছ স্ট্রোক খেলার ক্যারিবীয় ঝলক দেখানো একটু কঠিনই। মাশরাফির বলে ফ্লিক করে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে চেজের মারা ছক্কাটা ছাড়া সেটি দেখাও গেল না। শেষ দিকে কিমো পলের সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসটির (২৮ বলে ৩৬) কথা বাদ দিন। ওটা টিপিক্যাল ফাস্ট বোলারের ব্যাটিং। কখনো লেগে যায়, কখনো লাগে না।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে ব্যাটিং-বোলিং ছাপিয়ে বরং চোখে লেগে আছে একটি ক্যাচ। ১৯ রান করতে মিরাজ আর মুশফিকের সৌজন্যে দুবার 'জীবন' পেয়েছেন ড্যারেন ব্রাভো। এক দিক থেকে তা ভালোই হয়েছে। নইলে তো তামিম ইকবালের দুর্দান্ত ক্যাচটি দেখা হয় না! লং অফ থেকে ডান দিকে দৌড়ে পুরো শরীর শূন্যে ছুড়ে নিয়ে ধরা ক্যাচটি মিরপুরের মাঠ থেকে সরাসরি ঢুকে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেট আর্কাইভে। যেখানে আগে থেকেই তামিমের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশ দলের সেরা ফিল্ডারদের নাম করতে গেলে তাঁর নাম আসবে অনেক পরে। হয়তোবা আসবেই না। মজাটা হলো, আউটফিল্ডে বাংলাদেশের ফিল্ডারদের নেওয়া সেরা ক্যাচের তালিকা করতে যান, বারবার আসবেন তামিম।

টেস্টের স্পিনময় আক্রমণ থেকে ওয়ানডেতে প্রথাগত বোলিং আক্রমণে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে বাংলাদেশের। তিন পেসারের দলের বোলিংয়ের শুরুতেই যদিও দুই প্রান্তেই স্পিন! এই ম্যাচের বাংলাদেশ একাদশটাও এক অর্থে অপ্রথাগতই।
ওপেনিংয়ে দুটি জায়গার জন্য চার প্রার্থীর ব্যাটেই এমন রানের ফোয়ারা যে শেষ পর্যন্ত চারজনকে নিয়েই মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ। ব্যাটিং অর্ডারে এক থেকে তিন পর্যন্ত তিন ওপেনার! তামিম, লিটন ও ইমরুল। সর্বশেষ ওয়ানডের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচেও ওপেনিংয়ে নেমে সেঞ্চুরি করা সৌম্য ৬ নম্বরে। সেটিও বোলারদের ডানহাতি-বাঁহাতি ঝামেলায় ফেলার জন্য। সাকিবের বদলে মুশফিক আউট হলে মাহমুদউল্লাহই তাঁর আগে আসতেন। মুশফিক দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়লেন। এই উইকেট যা দাবি করে, ঠিক তেমন ব্যাটিং করে ৭০ বলে অপরাজিত ৫৫।

ব্যাটিংয়ে ক্যারিবীয় ঝলক না থাকলেও বোলিংয়ে তা যথেষ্টই থাকল। বোলিংয়ে 'ক্যারিবীয় ঝলক' মানেই তো গতির ঝড়। কেমার রোচও তা তুলতে জানেন, তবে খেলতে খেলতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাছে তিনি অনেকটাই ডালভাত। ওশান টমাস তা নন। তাঁর সঙ্গে কালই প্রথম দেখা। কদিন আগে ভারতে ওয়ানডে অভিষেকেই গতির ঝড় তুলে চিনিয়েছেন নিজেকে। এদিনও তাঁর সব বলই ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের ওপাশে। কয়েকটা ১৫০ কিলোমিটার ছুঁই–ছুঁইও। ২১ বছরের জ্যামাইকান তরুণ যে ক্যারিবীয় ফাস্ট বোলিংয়ের সোনালি সময়কে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ৫ ওভারে ৩৪ রানে ১ উইকেট তা কীভাবে বোঝাবে!

বড় কারণ সৌম্য সরকার। টমাসের প্রথম ৪ ওভারে মাত্র ১৮ রান। পঞ্চম ওভারে টমাসের বিদ্যুৎগতিকে কাজে লাগিয়েই পরপর দুই বলে কাট করে সৌম্যর চার আর ছয়। তামিমের ক্যাচ যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের হাইলাইট হয়, বাংলাদেশের ইনিংসে সৌম্যর ওই দুটি শট।
শেষে অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে ওই একজন।
মাশরাফি বিন মুর্তজা!