পরিসংখ্যানের তামিম, মাইলফলকের তামিম

তামিমের আফসোসের ২০১৮, আশার ২০১৯। ছবি: শামসুল হক
তামিমের আফসোসের ২০১৮, আশার ২০১৯। ছবি: শামসুল হক
>

বছরটা যেভাবে শুরু করেছিলেন, চোট বাইরে বসিয়ে না রাখলে তার শেষটা কী হতে পারত, তা নিয়ে শুধু আফসোসই করা যায়। মাঠে ফিরে দ্বিতীয় ম্যাচেই ছুঁয়েছেন দুটি মাইলফলক। গত পরশু সিলেটের টিম হোটেলে তামিমের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উৎপল শুভ্র। প্রথমে মাইলফলকের বিষয়টি দিয়ে শুরু হলেও তা ছাড়িয়ে গেল বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে

এক ম্যাচে দুই মাইলফলক
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২ হাজার রান ও মিরপুরে ৪ হাজার
উৎপল শুভ্র: গত ম্যাচে আপনি এমন এক শৃঙ্গে উঠেছেন, যেখানে এর আগে বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যানের পা পড়েনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২ হাজার রান করার মাইলফলক ছোঁয়ার অনুভূতিটা কেমন?
তামিম ইকবাল: বিশেষ কিছু না। হ্যাঁ, ভালো লেগেছে, অতটুকুই। এটা নিয়ে আমি খুব বেশি রোমাঞ্চিত না। যখন আমি প্রথম ১০ হাজার রান করেছিলাম, তখন খুব ভালো লেগেছিল। সেদিন যে ১২ হাজার হয়েছে, সেটা আমি জানতামও না। শুধু জানতাম, খুব কাছাকাছি আছি। মাঝখানে তো অনেক দিন খেলার বাইরে ছিলাম, নইলে হয়তো জানতাম। কারণ, সামনে কোনো মাইলফলক বা বিশেষ অর্জন আসছে-এই জিনিসগুলো আমি আগে থেকেই জানি। খেলার বাইরে থাকায় ১২ হাজার নিয়ে আমি চিন্তা করিনি। ভালো তো লেগেছেই, তবে আমার লক্ষ্য আরও অনেক বড়।
শুভ্র: আপনি কি খুব পরিসংখ্যান সচেতন-নিজের রান-টান সব মুখস্থ থাকে?
তামিম: আমার স্ট্যাটস বলেন, অন্যদের স্ট্যাটস বলেন, সবকিছু আমি জানি। জানি, দুনিয়াতে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, আমার দলে কে কী করছে না-করছে, বছরে আমার কত রান হয়েছে না-হয়েছে, কী অ্যাভারেজে খেলছি, লাস্ট তিন-চার বছর ধরে আমার অ্যাভারেজ কী, আই নো এভরিথিং।
শুভ্র: তাহলে তো একই দিন আরেকটা মাইলফলক ছোঁয়ার কথাও আপনার জানার কথা-মিরপুরে ৪ হাজার রান। সাকিবের হয়েছে এর আগে। এক ভেন্যুতে সবচেয়ে বেশি রান সাকিবের, এরপরই আপনার…
তামিম: না, না, সবচেয়ে বেশি রান আমার-আমার-আমার। ক্রিকেটে এক ভেন্যুতে সবচেয়ে বেশি রান আমার।
শুভ্র: আজকের প্রথম আলোতেই ছাপা হয়েছে, সাকিব আপনার ওপরে। আপনি নিশ্চিত রেকর্ডটা আপনার?
তামিম: হ্যাঁ, হান্ড্রেড পারসেন্ট। এটা আমার হয়েছিল এ বছরই ট্রাই নেশনে।
প্রশ্ন: তারপর সাকিব আপনাকে ছাড়িয়ে গেছেন মনে হয়...
তামিম: কীভাবে ছাড়াবে? তারপর খেলা হয়েছে কয়টা?
প্রশ্ন: এই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে সাকিবের মিরপুরে ৪ হাজার হয়েছে, দ্বিতীয় ম্যাচে হয়েছে আপনার...
তামিম: কীভাবে তা হয়! মিরপুরে সাকিব তো জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ওয়ানডে খেলেনি, তাই না? না, না, না। আমি কোয়াইট শিওর, আমি একটা ভেন্যুতে হাইয়েস্ট ছিলাম।
(মোবাইলে পরিসংখ্যান বের করে) এই যে দেখেন, মিরপুরে আমার রান সবচেয়ে বেশি-২৬১৯।
আচ্ছা, আচ্ছা, এটা তো শুধু ওয়ানডেতে, আপনি কি তিন ফরম্যাট মিলিয়ে বলছেন?
শুভ্র: হ্যাঁ, টেস্ট-ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে।
তামিম: তাহলে হয়তো ঠিক আছে। তবে ওয়ানডেতে মিরপুরে সবচেয়ে বেশি রান আমার।
শুভ্র: নিজের স্ট্যাটস সব মুখস্থ বললেন, বলুন তো, আপনার টেস্ট রান কত?
তামিম: একজ্যাক্ট ফিগার মনে নাই। ৪০৩৯ মনে হয়, নাকি ৪০৬৭! ফোর থাউজ্যান্ড সামথিং। মাঝখানে চারটা টেস্ট মিস না করলে একেবারে ঠিকটা বলে দিতে পারতাম। (তামিমের টেস্ট রান ৪০৪৯)।
শুভ্র: ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে?
তামিম: আমার একটা অভ্যাস আছে, একটা সিরিজের আগে আমি আমার রানটা জানি। তবে সিরিজ চলার সময় আর হিসাব রাখি না। সিরিজ শেষ হওয়ার পর আমি আবার জানি। এই সিরিজ শুরু হওয়ার আগে সিক্স থাউজ্যান্ড থ্রি হান্ড্রেড সিক্সটির মতো ছিল (আসলে ছিল ৬৩০৭)। এখন কত হয়েছে জানি না।

তামিম
তামিম


আফসোসের ২০১৮ ও আশার ২০১৯
শুভ্র: বছর তো প্রায় শেষ হতে চলল। একটা ওয়ানডে আর তিনটা টি-টোয়েন্টিই শুধু বাকি। পেছন ফিরে তাকালে কী মনে হয়? ইনজুরিতে না পড়লে ২০১৮ তো আপনার জন্য দারুণ একটা বছর হতে পারত। নিশ্চয়ই আফসোস হয়!
তামিম: ইনজুরি ইজ পার্ট অব দ্য গেম, আমি সব সময়ই বলি কথাটা। তবে তারপরও আফসোস লাগে, একটা রেকর্ড আমি সব সময় করতে চাইতাম-একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাটে বছরে এক হাজার রান। এই বছরে আমার সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল, প্রথম ৯ ম্যাচেই সাড়ে পাঁচ শ রানের মতো করে ফেলেছিলাম। বাকি সাড়ে চার শ রান করার জন্য আমার হাতে আরও ১১টা ম্যাচ ছিল। কিন্তু আমি ৮টা ওয়ানডে মিস করেছি ইনজুরিতে। এটার আফসোস অনেক বেশি।
শুভ্র: ‘তামিম ইকবালের ২০১৮’ বললে এশিয়া কাপে ভাঙা হাত নিয়ে ওই এক বল খেলার কথা আসবেই। এটা নিয়ে এমন ধন্য-ধন্য রব পড়ে যাবে, তা কি ভাবতে পেরেছিলেন?
তামিম: নেভার-নেভার। যখন নামছিলাম, একবারও ভাবিনি যে আজ যদি এক হাতে এক বল খেলে নিই, তাহলে অনেক মানুষ আমাকে অনেক ভালো কথা বলবে। অথবা আমার কোনো আইডিয়াই ছিল না যে এ রকম প্রতিক্রিয়া হবে। আমি ওই সিদ্ধান্তটা মাথা দিয়ে নিইনি, হৃদয় দিয়ে নিয়েছিলাম। আমার তো ব্যাটিং করতে যাওয়ারই কথা ছিল না। ফিজিও তো আমাকে কোনো সময়ই পারমিশন দেয়নি। ড্রেসিংরুমে কথা ছিল, মুশফিক স্ট্রাইকে থাকলেই শুধু আমি যাব। আমি এখনো আপনাকে বলতে পারব না, সেদিন কী ভেবে ব্যাট করতে গেছি। তবে এটা বলতে পারি, ওই একটা বলে আমার যে মনঃসংযোগ ছিল, জীবনে আর কোনো দিন আর কোনো বল আমি অমন মনঃসংযোগ নিয়ে খেলতে পারব না।
শুভ্র: এটা নিয়ে যত কমপ্লিমেন্ট পেয়েছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় কোনটা?
তামিম: দেখেন, এখানে দুইটা দিক আছে। আমি এখন যা বলব, এটা হয়তো অনেকেই বলবে না। তবে আমার মনে হয় বলা উচিত। সবাই আমাকে ভালো বলেছে, অনেক প্রশংসা করেছে, কিন্তু একটা সময় আমার খারাপ লাগতে শুরু করেছে। কারণ মনে হচ্ছিল, মুশফিক যা করেছে, সেটি আড়াল হয়ে যাচ্ছে। ও ১৪৪ রান করেছে, ম্যাচটা আমাদের হাতে এনে দিয়েছে। আমার এই একটা বল খেলার কারণে ও প্রাপ্য কৃতিত্বটা পাচ্ছে না। আমার এটা ভালো লাগেনি। এটা আমি মানুষের কাছে ভালো সাজার জন্য বলছি না। আমি আমার অনেক বন্ধুকে বলেছি, দিস ইজ রং। আমি যদি মুশফিকের জায়গায় থাকতাম, আমার খারাপ লাগত। কারণ, ও বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটা ইনিংস খেলেছে। আমাকে নিয়ে যত কথা হয়েছে, ওকে নিয়েও যদি তা হতো, তাহলে আমি আরও খুশি হতাম। মুশফিক কীভাবে এই জিনিসটা নিয়েছে, আমি জানি না। তবে আমি নিজে এই ফিলিংসটা জানি। অনেকবারই এমন হয়েছে, যখন মনে হয়েছে, আমি যা করেছি, সেটির প্রাপ্য স্বীকৃতি পাইনি, অন্য কেউ তা পেয়ে গেছে।
শুভ্র: বেশির ভাগ সময়ই তো সেটি সাকিব আল হাসান। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়েই যেমন মনে আছে, দুই ইনিংসে আপনি দুর্দান্ত দুটি ইনিংস খেললেন, কিন্তু সাকিব ব্যাটিং-বোলিং মিলিয়ে ঠিকই আপনাকে ছাপিয়ে গেল। আপনার তো আর বোলিং নেই…
তামিম: না, না, আমি শুধু সাকিবের কথা বলব না। নির্দিষ্ট কারও কথাই না। তবে অনেকবারই আমার মনে হয়েছে, অন্য কেউ আমার কৃতিত্বটাকে আড়াল করে দিয়েছে। আমার খারাপ লেগেছে। যে কারণে আমি মুশফিকের ব্যাপারটা আরও ভালো বুঝতে পেরেছি।

২০১৯ ও বিশ্বকাপ
শুভ্র: ২০১৯ তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য খুব বড় একটা বছর। বিশ্বকাপ নিয়ে তো অনেক আশা...
তামিম: দেখেন, আমার কাছে মনে হয়, দল হিসেবে আমাদের এখনো অনেক কিছু ঠিক করার আছে। বাংলাদেশ ওয়ানডে ভালো খেলছে বলেই বিশ্বকাপে ভালো করবে এমন কোনো কথা নেই। অবশ্যই অনেক আশা থাকবে, বিশ্বকাপটা সম্ভবত আমাদের সেরা সময়ে আসছে। কারণ, যে পাঁচজন সিনিয়র ক্রিকেটার নিয়ে কথা হয়, তাঁরা সেরা সময়ে থাকবে। আমাদের দলটাও ভালো। তবে উপমহাদেশে খেলা আর ইংল্যান্ডে খেলার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

পঞ্চপাণ্ডবের শততম ম্যাচ নিয়ে
শুভ্র: মিরপুরে আপনার দুই মাইলফলক ছোঁয়ার ম্যাচটি আরও একটা কারণে বিশেষ ছিল। ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নাম পেয়ে যাওয়া আপনাদের পাঁচজনের একসঙ্গে শততম ম্যাচ।
তামিম: এটার ব্যাপারে কোনো আইডিয়া ছিল না।
শুভ্র: আগে জানতেন না?
তামিম: না। ম্যাচের দিনই জেনেছি।
শুভ্র: যেকোনো ম্যাচ হারাই কষ্টের। বিশেষ উপলক্ষ ছিল বলে এটিতে হারার কষ্টটা কি একটু বেশি?
তামিম: অবশ্যই। কারণ, আমরা যেভাবে শুরু করেছিলাম-আমি ফিফটি করেছি, মুশফিক ফিফটি করেছে, সাকিব ফিফটি করেছে, আমরা চাচ্ছিলাম রিয়াদ ভাইও একটা ফিফটি করুক। আমি আর মুশফিক বলছিলামও, রিয়াদ ভাইও যদি ফিফটি করে, তাহলে চারজনেরই ফিফটি হয়। এরপর মাশরাফি ভাই যদি বোলিংয়ে ভালো করেন এবং আমরা জিতি, তাহলে এটা আমাদের জন্য বিশেষ একটা ম্যাচ হয়ে থাকবে। জিতলে আমরা এই জিনিসটা একটু অন্যভাবে উদ্‌যাপন করতে পারতাম। আজ থেকে ১০ বছর পর যখন খেলা ছেড়ে দেব, তখন এই এক শততম ম্যাচের কথা মনে হলে একটা অন্য রকম ফিলিং হতো। কিন্তু তা তো আর হলো না।

তামিম
তামিম


তাঁর চোখে বাকি চারজন
মাশরাফি বিন মুর্তজা
যেদিন উনি খেলা ছাড়বেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট বিরাট একটা জিনিস হারিয়ে ফেলবে-তাঁর নেতৃত্ব। আমার মনে হয়, উনি সম্ভবত, সম্ভবত কেন, উনিই বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ফাস্ট বোলার। তবে এর চেয়েও বেশি অভাব অনুভূত হবে ড্রেসিংরুমে ওনার উপস্থিতিটা। মাশরাফি বিন মুর্তজা আমার কাছে সব অর্থেই একজন নেতা। সুযোগ থাকলে আমি চিরদিন ওনাকে ড্রেসিংরুমে পেতে চাইতাম। উনি ড্রেসিংরুমে থাকলেই আমি অনেক নির্ভার হয়ে যাই। যখন ব্যাটিং করি, উনি বেরিয়ে এসে হাততালি দেন, ওটাও আমাকে নির্ভার করে দেয়। উনি খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর ওনাকে আমি খুব মিস করব।

সাকিব আল হাসান
অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান এক ক্রিকেটার। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিনটাতেই ওর যে সামর্থ্য, তা দেখে আমি মাঝে মাঝেই বিস্মিত হয়ে যাই। বলতে পারেন, হতবাকও। আমি এটা ওকে কখনো জিজ্ঞেস করি নাই, তবে কখনো কখনো জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়েছে, বাংলাদেশের পক্ষে ও মাঝেমধ্যেই যা করে, তাতে ও নিজেও কি কখনো কখনো বিস্মিত হয়? প্রথম আলোর মাধ্যমেই প্রশ্নটা ওকে করে রাখলাম।

মুশফিকুর রহিম
একটা কথা আছে না, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই কথাটাকে যদি অন্যভাবে বলতে হয়, আমি বলব-মুশফিকুর রহিম। আর কিছু বলব না। পরিশ্রম করলে ফল পাওয়া যায়-আমার কাছে এই কথাটার অর্থ ‘মুশফিকুর রহিম’। ওর সম্পর্কে এতেই আসলে সব কথা বলা হয়ে যায়।

মাহমুদউল্লাহ
আমি মনে করি, শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেটের নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেরই সবচেয়ে আন্ডাররেটেড ক্রিকেটার। তবে দলের আমরা সবাই ওনার মূল্য বুঝি। উনি এমন একজন খেলোয়াড়, যিনি তাঁর ব্যাটিং পজিশনের কারণেই খুব বেশি সেঞ্চুরি করেন না। কিন্তু ওনার ৩০-৪০-৫০ এর ইনিংসগুলো মহামূল্যবান। যাঁরা শুধু স্কোরকার্ড দেখে ক্রিকেটারের বিচার করেন, তাঁরা মাহমুদউল্লাহর মূল্য বুঝতে পারবেন না। আমি বলব, দলে সবচেয়ে কঠিন কাজটা উনি করেন। তাঁকে যতটুকু কৃতিত্ব দেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর পাওনা।