টেন্ডুলকার ভুলবেন কীভাবে আচরেকার স্যারকে?

রমাকান্ত আচরেকারের কাছে অনেক ঋণ টেন্ডুলকারের। ফাইল ছবি
রমাকান্ত আচরেকারের কাছে অনেক ঋণ টেন্ডুলকারের। ফাইল ছবি
>

শচীন টেন্ডুলকার ক্রিকেট শিখেছিলেন রমাকান্ত আচরেকারের কাছে। তিনি খুব বিখ্যাত ক্রিকেটার বলতে যা বোঝায় সেটি ছিলেন না। কিন্তু তিনি পরিণত হয়েছেন ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা কোচে। মুম্বাইয়ের ময়দানে তিনি টেন্ডুলকারের মতোই ক্রিকেটের স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছিলেন অজস্র ছেলের মধ্যে। তাঁর মৃত্যুতে মুম্বাইই কেবল নয় ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গনও শোকস্তব্ধ

ক্রিকেটার হিসেবে খুব বিরাট কিছু তিনি কখনোই ছিলেন না। ষাটের দশকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার হয়ে হায়দরাবাদ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের বিপক্ষে খেলা একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচই তাঁর ক্যারিয়ারের সম্বল। কিন্তু কোচ হিসেবে রমাকান্ত আচরেকার সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসেরই অংশ। তাঁর হাতেই যে গড়ে উঠেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার—শচীন টেন্ডুলকার। আচরেকারের মৃত্যুর পর তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য শোকস্তব্ধ। সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরে ক্রিকেট শেখার সে দিনগুলি চোখের সামনে যে বারবার ভেসে উঠছে ক্রিকেট কিংবদন্তির। গুরুর মৃত্যুর পর তাই তাঁর আবেগমথিত প্রতিক্রিয়া, ‘তাঁর কাছ থেকেই আমার ক্রিকেটের হাতেখড়ি। আমার জীবনে তাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। স্যার ছোট থেকে যে ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন, আমি দাঁড়িয়ে আছি সে ভিতের ওপরই। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন সোজা খেলতে ও জীবন এগিয়ে নিয়ে যেতে।’
সেই ছোট্ট বেলায় রমাকান্ত আচরেকারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল টেন্ডুলকারকে। বোলার হতে চাওয়া টেন্ডুলকারকে বানিয়েছিলেন ব্যাটসম্যান। শিখিয়েছিলেন ব্যাটিংয়ের কেতা। বাকিটা তো ইতিহাস! সেই ছোট্ট টেন্ডুলকার পরের ৩০ বছরে পরিণত হলো বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। সর্বকালের অন্যতম সেরাও। ক্রিকেটের এমন কোনো ব্যক্তিগত রেকর্ড বাদ থাকল না, যেটি নিজের মালিকানায় নেননি টেন্ডুলকার। কিন্তু কী আশ্চর্য, ক্রিকেটীয় উৎকর্ষের চূড়ায় অবস্থান করেও টেন্ডুলকার নিজের প্রেরণা, নিজের বাজে সময়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সেই আচরেকারকেই। গুরুর সঙ্গে কথা বলেই যেন নতুন উদ্যম খুঁজে পেতেন। শক্তি পেতেন প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার।
টেন্ডুলকার কাল গুরুর মৃত্যুর পর একটা দারুণ কথা লিখেছেন। আবেগী হলেও সেই কথাটিই সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কোচ রমাকান্ত আচরেকার আসলে কী ছিলেন। টুইটারে টেন্ডুলকার লিখেছেন, ‘এবার হয়তো স্বর্গে গিয়েও ক্রিকেটের উৎকর্ষ বাড়িয়ে তুলবেন আচরেকার স্যার।’
আচরেকারের আরেক শিষ্য বিনোদ কাম্বলি। ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারটা তাঁর কোনো দিনই টেন্ডুলকারের ধারেকাছে যেতে পারেনি। সেটি নিয়ে আচরেকার স্যারের ক্ষোভ বা দুঃখ ছিল কিনা, সেটির ধার না ধেরেই কাম্বলির টুইট, ‘আমার ক্রিকেটীয় সত্তার জন্ম হয়েছে আচরেকার স্যারের হাতেই। আপনার অভাব অনুভব করব সব সময়ই। ওপরেও শান্তিতে থাকুন, ভালো থাকুন স্যার।’
মুম্বাইয়ের ক্রিকেট মহলে অন্য চোখেই দেখা হয় আচরেকার স্যারকে। কয়েক দশকে প্রায় হাজার খানিক ছাত্র তৈরি করেছেন তিনি। সবাই যে ‘শচীন টেন্ডুলকার’ হতে পেরেছে, এমনটি হয়তো নয়, কিন্তু তিনি ক্রিকেটের যে উন্মেষ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেটির প্রভাব অনেক বিস্তৃত। ভারত সরকারও তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে শ্রদ্ধার সঙ্গেই। তিনি পেয়েছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। গুরু হিসেবে তিনি সত্যিই ছিলেন পুরোপুরি অন্যরকম। তাঁর কাছে ক্রিকেট ছিল নিছক এক খেলা নয় বিধাতার আরাধনাও।
২০১৩ সালের নভেম্বরে ২৪ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন টেন্ডুলকার। নিজের বিদায়ী বক্তৃতার একটা বড় অংশ জুড়েই ছিল স্যার আচরেকার, ‘১১ বছর বয়স থেকে আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আচরেকার স্যার। স্যার কোনো দিন বলেননি , “ভালো খেলেছ”। পাছে আমি আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকি। ভালো খেললে তাঁর চেহারার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারতাম, তিনি কতটা খুশি। খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠত তাঁর চোখ-মুখ। চেহারার মধ্যেই একটা আনন্দ ঝিলিক দিত। না চাইতেই মিলত ভেলপুরি, ফুচকা।’
টেন্ডুলকারই কেবল নয়, অন্য ছাত্রদের মনেও নিশ্চয়ই ভিড় করছে স্যার আচরেকারকে নিয়ে অজস্র স্মৃতি। সে সব স্মৃতি আনন্দের, বেশির ভাগই বাকিটা জীবন রোমন্থন করে যাওয়ার।