এক 'ঐতিহ্যবাহী' বাসচালকের কষ্টমাখা আনন্দ

মোহামেডানের পুরোনো বাস। ছবি: প্রথম আলো
মোহামেডানের পুরোনো বাস। ছবি: প্রথম আলো
>

২৮ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান ক্লাবের বাস চালাচ্ছেন আবদুল করিম। ৬০ বছর বয়সে এসে শোনালেন নিজের জীবনের গল্প

অনুশীলন থেকে ফিরে খেলোয়াড়েরা নেমে পড়তেই খুব যত্ন নিয়ে বাসটি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করলেন চালক। ঝাড়ু পর্ব শেষে পানির পাইপ ও বড় সাইজের একটি ন্যাকড়া নিয়ে ধুতে শুরু করলেন বাসের বাইরের অংশ। মোহামেডান ক্লাব তাঁবু থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হতে হচ্ছিল, কোন ভাড়াটে চালক এত পরম যত্নে বাস ধোয়ামোছা করেন!

এই বাসচালক একটু আলাদা ঘরানার। প্রায় ২৮ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান লিমিটেডের খেলোয়াড়দের বাস চালাচ্ছেন আবদুল করিম, সেই ১৯৯১ সাল থেকে। দুই যুগেরও বেশি সময়ে কত কিছুই না বদলে গেছে মোহামেডানের। দুর্দান্ত প্রতাপ ও আভিজাত্য হারিয়ে মোহামেডান এখন ভাঙা হাট। কিন্তু সাদা-কালোদের স্টিয়ারিং হাতে দিব্যি চলে যাচ্ছে করিমের জীবন। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর স্বপ্নের রংটা যে ‘সাদা-কালো’।

গুলিস্তান-নরসিংদী রুটে যাত্রীবাহী বাস চালাতেন করিম। কিন্তু মনটা পড়ে থাকত সাদা-কালো জার্সিধারীদের কাছে, খেলার মাঠে। বড় খেলোয়াড় হয়ে মোহামেডানের জার্সিতে মাঠে নামার সামর্থ্য নেই; দর্শক হয়ে মাঠে বসে খেলা দেখবেন—বাসের ট্রিপের চাপে তা–ও করা হয়ে উঠছিল না সব সময়। তাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন মোহামেডানের বাসচালক হওয়ার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হতে পারে, ‘এটাও কোনো মানুষের স্বপ্নও হতে পারে?’ কিন্তু মাথায় রাখতে হবে সেটা নব্বইয়ের দশক। বাংলাদেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগ। মোহামেডান মানেই দেশের প্রায় ‘অর্ধেক’ মানুষের আবেগের নাম। সেই আবেগের রথে করিম উঠে বসার সুযোগ পেলেন অবশেষে।

করিমের বাসের গল্পটা অবশ্য আরও পুরোনো। তাঁর ভাষ্যমতে, ১৯৮৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে নারায়ণগঞ্জের এক সমর্থকের কাছ থেকে একটি বাস উপহার পায় মোহামেডান। দুজনের হাত বদলে সেই বাসের চালকের দায়িত্ব আসে বড় ভাই আবদুল রহিমের হাতে। সুযোগ পেলেই বড় ভাই রহিমের কাছে আরজি জানাতেন করিম, ‘আপনার যদি অন্য কোথাও চাকরির সুযোগ হয়, আমাকে মোহামেডানের চাকরিটা দিয়েন।’ করিমের কাছে সেই সুযোগ আসে ১৯৯১ সালে। বড় ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘১৮০০ টাকা বেতনে তোর চলব?’ বেতন নিয়ে ভাবতে করিমের বয়েই গেছে। সেই যে সাদা-কালোদের বাসের স্টিয়ারিং ধরেছেন, হাত জোড়া এখনো ছাড়েনি সেটি।

মোহামেডানের নতুন বাসের সঙ্গে আবদুল করিম। ছবি: প্রথম আলো
মোহামেডানের নতুন বাসের সঙ্গে আবদুল করিম। ছবি: প্রথম আলো

গত ২৩ অক্টোবর মোহামেডানের বহরে নতুন বাস যোগ হয়েছে। সাভারের আশুলিয়া থেকে বাসটি চালিয়ে ক্লাবে নিয়ে এসেছেন করিমই। নতুন বাসে বসে করিম ফিরে যান তাঁর পুরোনো স্টিয়ারিংয়ের গল্পে। যেখানে বসার সুবাদে সমর্থকদের কাছে তিনিও ছিলেন নায়কের মতো। মোহামেডানের বাসের চালক বলে কথা! তাঁর সঙ্গে যে সাব্বির, শফিকুল ইসলাম মানিক, কায়সার হামিদদের মতো বড় বড় তারকার সখ্য! আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে সোনার হরিণ হয়ে ওঠা টিকিটও থাকে তাঁর বুকপকেটে। এমন মানুষের গুরুত্ব কেমন হওয়া উচিত, তা সেকালের ফুটবলপ্রেমীরাই বোঝেন (ইদানীং ক্রিকেট–সংশ্লিষ্টরা বিপিএলের সময় টের পান)। বেশি দিন নয়, এই তো নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা।

করিম এখনো প্রথম দিনের গল্পটা বলতে পারেন একদমে, ‘আমি আসার পর প্রথমে ক্রিকেট দলকে পাই। ভোরে বিকেএসপি রওনা হলাম। নান্নু (মিনহাজুল আবেদিন) ভাই আমাকে আশুলিয়া না হয়ে নবীনগর হয়ে বিকেএসপি যাওয়ার রাস্তা বলে দিলেন। আমার পেছনে তারকা খেলোয়াড়রা। আমার হাত তো কাঁপাকাঁপি। হা. . হা...’

করিমের জীবনে শুরু হলো মোহামেডানের সঙ্গে থাকার রোমাঞ্চ। ফুটবলে বড় ম্যাচ জয়ের পর সমর্থকেরা নাকি বাসের ওপর চুমু দিতেও ছাড়ত না। কিন্তু হেরে গেলেই কেল্লাফতে। বাস নিয়ে আর আসার জো নেই। মাথা ফাটার গল্পও আছে অনেক। সেই ভয়ংকর গল্প শোনাতেও সেই হারানো দিনের ফুটবল রোমাঞ্চ খেলে যায় করিমের চোখমুখে, ‘মিরপুর মাঠে খেলা ছিল। আবাহনীর সঙ্গে ১-০ গোলে হেরে যাই। খেলা শেষ করে বের হয়ে দেখি গ্লাস ভাঙা, বাসের মধ্যে খালি ইট আর ইট। পুলিশ প্রহরায় খেলোয়াড়দের নিয়ে বের হলাম। শেওড়াপাড়া আসতে ব্যারিকেড দিল সমর্থকেরা। আমি কোনোরকমে গাড়িটা টান দিতেই দর্শকেরা ইট মারল। কপালে হাত দিয়ে দেখি রক্ত।’

ম্যাচ হারলে খেলোয়াড়দের কাছে করিম ছিলেন এক স্বস্তির নাম। দল জিতলে করিমের প্রয়োজন তেমন অনুভব না হলেও হেরে গেলেই খেলোয়াড়দের কাছে মুশকিল আসান হিসেবে হাজির হতেন তাঁদের বাসচালক, ‘সাব্বির ভাই (রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির) বলতেন, করিম যেমনে পারো আমাগো বাঁচিয়ে ক্লাবে নিয়ে যাও।’

সময়ের পালাবদলে মোহামেডান এখন রং হারিয়েছে। ক্লাব এখন ঘোষণা দিয়ে বলে তারা শিরোপার জন্য লড়ছে না। দল হারলেই কী আর জিতলেই-বা কী! তাঁর কানে এখন আর তাই বাজে না খেলোয়াড়দের বাঁচিয়ে ক্লাবে নিয়ে যাওয়ার আরজি। নেই দর্শকদের টিকিটের আবদার। করিমের মোহামেডান তো রং ওঠা ফিটনেসবিহীন সেই পুরোনো বাসের মতো। সবকিছুর জন্যই আফসোস ঝরে করিমের কণ্ঠে। তবু মোহামেডানের বাসচালক হওয়ার মধ্যেই তাঁর সব আনন্দ, ‘দলটা কী হয়ে গেল। সমর্থকেরা আমার গাড়িতে আর ইটা মারে না। কষ্ট লাগে। এই ক্লাবটাকে খুব ভালোবাসি। ক্লাবের বাসটাকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করি।’

৯৫০০ টাকা বেতন পাওয়া করিমের কষ্ট ও ভালোবাসার কথাটা কি শুনতে পান মোহামেডানের কর্মকর্তারা? করিমের বাস বদলে এখন ঝাঁ–চকচকে হয়েছে, তাঁর ক্লাব কি ফিরে পাবে পুরোনো গৌরব? আলো ঝলমলে দিনগুলো ফিরে পেতে মোহামেডান ক্লাবটাকে যে বড্ড দরকার বাংলাদেশের ফুটবলের!