বিকেএসপির লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ওরা যায় কোথায়?

>

বিকেএসপিতে খেলোয়াড় উঠে না আসার গলদটা মোটামুটি এখন সবার-ই জানা। এতে সবার আগে আসবে যুগোপযোগী পরিকল্পনার অভাব, ভর্তি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অদক্ষ কোচিং স্টাফ। দুর্নীতির অভিযোগের আঙুল প্রশাসনের উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের দিকেই বেশি।

ডিমের কুসুমের মতো সূর্য। কুয়াশার চাদরে ঢাকা বাংলাদেশে ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) রাস্তা। আধো অন্ধকারে অনেক দূর থেকেই শোনা যাচ্ছে স্বপ্নবাজদের কলকাকলি। কাছে গিয়ে বোঝা গেল তাদের মনে সংশয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা, উচ্চতা পরীক্ষা, নাকি ধরা পড়ে যায় আসল বয়সটা। সঙ্গে ব্যাটিং-বোলিংয়ের দুশ্চিন্তা তো ঘুরপাক খাচ্ছেই মাথায়। তবু সব পরীক্ষা উতরে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস নিয়ে দুরু দুরু বুকে ওরা দাঁড়িয়ে লম্বা লাইনে।

প্রশ্ন জাগে মনে, খেলোয়াড় হওয়ার জন্য প্রতি বছর এত বড় লম্বা লাইন। তাহলে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এত হায় হায় রব কেন! কেন-ই বা বোদ্ধারা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন দেশের ক্রিকেট ভবিষ্যৎ নিয়ে, আর কেন-ই বা মালদ্বীপের কাছেও পাঁচ গোল হজম করবে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরেও এশিয়ান গেমসে নেই পদকের সম্ভাবনা। এশিয়াডের কথা বাদ দিন, দক্ষিণ এশিয়ান গেমসেও পদকের জন্য হাহাকার। তাহলে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো এত খেলোয়াড় যাচ্ছে কোথায়?

ক্রীড়াঙ্গনে পিছিয়ে থাকার পেছনে সমস্যা আছে অনেক। তবে বিকেএসপি থেকে পর্যাপ্ত খেলোয়াড় উঠে না আসাও অন্যতম একটি কারণ।

সাতসকালে সবাই হাজির ক্রিকেটার হওয়ার পরীক্ষা দিতে। ছবি: প্রথম আলো
সাতসকালে সবাই হাজির ক্রিকেটার হওয়ার পরীক্ষা দিতে। ছবি: প্রথম আলো

১৬ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল খেলোয়াড় তৈরির কারখানা বিকেএসপিতে নতুন বছরের ভর্তি পরীক্ষা। গতকালই ছিল শেষ দিন। ১৮টি ডিসিপ্লিনে ভর্তি বাছাইয়ে নাম লেখাতে এসেছিলেন মোট পাঁচ হাজার ১৪ জন। এর মধ্যে ১৬৮৬ বাদ পড়েছে স্বাস্থ্য পরীক্ষায়। বাকি ৩৩২৮ জনের মধ্যে ক্রিকেটে সর্বাধিক ২০৫১, ফুটবলে ৭৭৩ ও হকিতে ৬৬ জন। বাকি ১৫টি খেলার মধ্যে শুটিংয়ে ৫৭ এবং সাঁতারে ৫৭। বিপুলসংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে বিকেএসপির সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটি হতে পারত সবচেয়ে স্বচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া। ‘হতে পারত’— বলার কারণটাতে না হয় একটু পরেই আসছি।

শুক্রবার ও শনিবার ভোরে বিকেএসপিতে পা রেখেই দেখা মিলল প্রায় হাজার খানেক ভবিষ্যৎ ক্রিকেটারের। সবার কাঁধেই ঝোলানো বড় ব্যাগ, হাতে ফাইলপত্র। কেউ পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে নিজেকে ঝালিয়ে নিচ্ছে। বয়সে কম হলেও সবারই চোয়ালবদ্ধ মুখ, উতরে যেতে হবে প্রাথমিক পরীক্ষায়। ক্রিকেটার হওয়াটা এখন বেশির ভাগ বালক বা কিশোরের স্বপ্ন। অনেকেই মনে করে, বিকেএসপি থেকে যেহেতু সাকিব, মুশফিকদের মতো তারকারা উঠে এসেছেন, তাই এখানে ভর্তি হতে পারলেই নিশ্চিত তারকা। তাই প্রতিবছর বড় হচ্ছে লাইন। কিন্তু মান সম্মত খেলোয়াড় আর উঠে আসছে কোথায়।

ফুটবলের অবস্থাও একই। হ্যাঁ, প্রতি বছর হয়তো একটা করে সাকিব বা মুশফিক বের হবে না, তাই বলে সরকারি অর্থায়নে বিশাল জায়গা জুড়ে সব সুযোগ-সুবিধার সমারোহ ঘটিয়ে যুগে একটা তারকা খেলোয়াড় বের করা, এ তো প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের স্কুল মাঠের একাডেমি থেকেও তুলে আনা সম্ভব!

বিকেএসপিতে খেলোয়াড় উঠে না আসার গলদটা মোটামুটি এখন সবার-ই জানা। এতে সবার আগে আসবে একটি যুগোপযোগী পরিকল্পনার অভাব, ভর্তি প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ও অদক্ষ কোচিং স্টাফ। দুর্নীতির অভিযোগের আঙুল প্রশাসনের উচ্চস্তরের কর্তাদের দিকে বেশি থাকলেও কোচরাও নেই এর বাইরে। অর্থ বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্বজনপ্রীতি সবই নাকি এখন বিকেএসপিতে ‘ডাল ভাত’। অভিযোগটা যে অসত্য নয়, তা বিকেএসপি থেকে উঠে আসা খেলোয়াড় তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে।

দেশের একাডেমিগুলোর সঙ্গে বিকেএসপির প্রতিযোগিতাটা মূলত ক্রিকেট ও ফুটবলে। জাতীয় দলের কথা বাদ দেওয়া যাক। এশিয়াডে অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলে কাতারকে হারানো বাংলাদেশ দলের একাদশে ছিল না বিকেএসপির কোনো ফুটবলারই। শেষ কয়েক বছরে উঁচু মানের কোনো ক্রিকেটারই তৈরি হয়নি প্রতিষ্ঠানটি থেকে। পাইপলাইনেও হাহাকার। নিউজিল্যান্ডে শেষ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বিকেএসপির ছাত্র ছিল মাত্র দুজন। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসের সঙ্গে মেলালে সংখ্যাটা একেবারেই পাতে নেওয়া যায় না।

খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লাইনে সারিবদ্ধ খুদেরা। ছবি: প্রথম আলো
খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে লাইনে সারিবদ্ধ খুদেরা। ছবি: প্রথম আলো

বিষয়গুলো স্বীকার করছেন বিকেএসপির সূচনালগ্ন থেকে হকি কোচের দায়িত্ব পালন করে গত বছর অবসরে যাওয়া কাওসার আলী, ‘প্রশাসনের বড় স্তরের কর্মকর্তারা সবাই অস্থায়ী। তাঁরা আজ আছে, কাল নেই। ঘন ঘন প্রশাসন বদলটা বিকেএসপির খুব ক্ষতি করে আসছে। ফলে বিকেএসপি নিয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী যুগোপযোগী পরিকল্পনা গড়ে ওঠে না। এখন ভালো কোচের অভাব আছে। ভর্তি প্রক্রিয়ায় দুর্বলতা আছে। বিচ্ছিন্নভাবে তো শোনা যায় ভর্তি বাণিজ্যের কথাও। আর সবচেয়ে বড় দায়, বিকেএসপির ব্যর্থতা নিয়ে কাউকে কখনো হতাশা প্রকাশ করতে দেখি না।’

পাঁচ মাস আগে নতুনে দায়িত্ব নিয়ে এই অভিযোগগুলো থেকে বিকেএসপিকে রক্ষা করার জন্য সব চেষ্টাই করছেন বিকেএসপির বর্তমান মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আনিছুর রহমান। ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নিয়ে এসেছিলেন কোচ, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বসিয়েছিলেন ক্যামেরা, বাছাই পরীক্ষা চলাকালীন সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে ছিল নিষেধাজ্ঞা। আর সব বিষয় নিজেই তদারকির জন্য ছুটেছেন বাইসাইকেল নিয়ে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কোচই ভর্তি প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে, ‘এবারের ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো লক্ষণ হলো কাকে নিতে হবে বা কার দিকে খেয়াল রাখতে হবে, এমন কোনো চাপ নেই। মহাপরিচালক স্যার কোনো সুপারিশ রাখতে রাজি নন। খুব স্বচ্ছভাবে খেলোয়াড় বাছাই করার সহযোগিতা পেয়েছি। এইভাবে সবগুলো ধাপ শেষ করা গেলে এবারের ভর্তি প্রক্রিয়া পুরোপুরি সফল হবে।’

শেষ পর্যন্ত স্বচ্চভাবেই খেলোয়াড় বাছাইয়ের সবগুলো ধাপ শেষ হবে, এ আশা তো অনেকেরই। কিন্তু ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই বর্তমান মহাপরিচালকের বদলির আদেশ চলে এসেছে প্রতিষ্ঠানটিতে। অর্থাৎ ভর্তি প্রক্রিয়ার আগেই শেষ হলো বর্তমান মহাপরিচালকের বিকেএসপি অধ্যায়। এখন প্রশ্ন হলো, এভাবে ভর্তি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ধরে রাখা যাবে তো?