গ্রিক দেবতা হতে পারবেন সিৎসিপাস?

স্বপ্ন সত্যি করার হাসি তো এ রকমই হয়। ছবি: এএফপি
স্বপ্ন সত্যি করার হাসি তো এ রকমই হয়। ছবি: এএফপি

‘দেজা ভ্যু’ দেখছেন হয়তো রজার ফেদেরার। ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০০১ সালের উইম্বলডন। সেবার ১৫তম বাছাই হিসেবে উইম্বলডনে এসে পিট সাম্প্রাসকে হারিয়ে দিয়েছিলেন ২০ বছর বয়সী ফেদেরার। টানা দুইবার উইম্বলডন জেতা সাম্প্রাসকে হারিয়ে টেনিস বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন ফেদেরার। সে ম্যাচের আগে ক্যারিয়ারে মাত্র একটি শিরোপা ছিল তাঁর ঝুলিতে। সবকিছুই তো মিলে যাচ্ছে! রজার ফেদেরার ও স্তেপানোস সিৎসিপাসের মধ্যে একটাই পার্থক্য, কোর্টটা অল ইংল্যান্ড লন কোর্টের বদলে রড লেভার অ্যারেনা। গ্রিসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে কোনো গ্র্যান্ড স্লামের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা স্তেপানোস সিৎসিপাসের গল্পটাই একটু শোনা যাক।

গ্রিক তারকাদের প্রসঙ্গ টানলেই চলে আসে গ্রিক পুরানের কোনো চরিত্র। যে কারও জীবনকেই যে পুরানের কোনো না কোনো চরিত্রের ছাঁচে ফেলা সম্ভব। ফেদেরারকে হারিয়ে এরই মাঝে জন্ম দিয়েছেন ‘গ্রিক ট্র্যাজেডি’র, কিন্তু সিৎসিপাসের নিজের গল্পটা কেমন হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। গ্রিক দেবতাদের মতো উজ্জ্বল হবেন নাকি নায়ক হতে গিয়ে হারিয়ে যাবেন সিৎসিপাস, সেটা জানতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত ইঙ্গিতটা ভালোর দিকেই।

নানা সার্জেই স্যালনিকোফ ছিলেন লেভ ইয়াশিনের সতীর্থ, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৫৬ স্টকহোম অলিম্পিকে জিতেছিলেন স্বর্ণ। মা ছিলেন টেনিস খেলোয়াড়; ক্যারিয়ারটা চালিয়ে গেলে হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবেই তাঁকে ধরা যেত। ১৬ বছর বয়সেই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেরা টেনিস খেলোয়াড়। বাবা অ্যাপোস্তোলাস সিৎসিপাস ছিলেন টেনিস কোচ। কোর্টে পা রাখতে এর থেকে বেশি আর কী দরকার হয়?

রাশিয়া থেকে গ্রিস, পথটা কম দূর নয়। এত দূরের পথটা ছোট্ট করে আনল লাল মাটির কোর্ট। এথেন্স ওপেনে খেলতে এসেছিলেন মা জুলিয়া অ্যাপোস্থিলি। বেছে বেছে সে ম্যাচেই আম্পায়ার ছিলেন অ্যাপোস্তোলোস। সেখানেই প্রথম দেখা, এরপর প্রতিটি প্রেমের গল্প যেভাবে এগোয় আরকি। দেখা, প্রণয়, প্রেম, আর শেষ পরিণতি দুজন দুজনের। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেই রাশিয়া ছেড়ে নিজের স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন গ্রিসে। স্বামী নিজে চালাতে থাকেন টেনিস কোচিং, আর জুলিয়া হয়ে যান টেনিস ইনস্ট্রাক্টর।

মা-বাবাকে পাশে রেখে শিরোপা হাতে নেওয়ার আনন্দই আলাদা। ছবি: টুইটার
মা-বাবাকে পাশে রেখে শিরোপা হাতে নেওয়ার আনন্দই আলাদা। ছবি: টুইটার

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই টেনিস ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে ছিলেন এথেন্সে, তখন জন্ম হয় স্তেপানোসের। যে সন্তানের জন্মের সময়ই কর্তব্যরত ডাক্তার বলেছিলেন, ‘সে মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে এসেছে, যেভাবে টেনিস খেলোয়াড়রা ম্যাচ জয়ের পরে বেড়িয়ে আসে।’ টেনিস কোর্টে পা ফেলতে বেশি সময় নেননি স্তেপানোস। বাবার সঙ্গে টেনিস কোর্টে প্রবেশ মাত্র তিন বছর বয়সে, ‘আমার মনে আছে তিন বছর বয়সে আমাকে বাবা হাতে করে বিটুইন দ্যা গ্যাপ খেলানো শিখিয়েছিলেন।’ টেনিস না, আগ্রহ ছিল ফুটবল আর সাঁতারেও। একদিন ফ্রান্সে মাঝরাতে বাবাকে হঠাৎই বলে বসলেন, কিছু হলে টেনিস খেলোয়াড়ই হব। বয়সটা তখন মাত্র নয়। টেনিসে পাকাপাকিভাবে হাতেখড়ি অবশ্য হয়েছে ছয় বছর বয়সে। টেনিসের নিয়মিত ট্রেনিং নিতে থাকেন গ্লিফ্যাডা ট্রেনিং সেন্টার থেকে।

সেই থেকে শুরু। টেনিস কোর্টকে নিজের ঘর বানানো শুরু করলেন মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকে। জুনিয়র টেনিসে হাতেখড়ি ২০১৩ সালে। দ্বিতীয় টুর্নামেন্ট খেলতে নেমেই ফাইনাল খেলার স্বাদ পেয়ে যান। কিন্তু শিরোপাভাগ্য তখনই তাঁর হয়ে ওঠেনি। জুনিয়র গ্র্যান্ড স্লামে সুযোগ পান ২০১৫ সালে, কিন্তু দৌড় শেষ হয় কোয়ার্টারেই। বছর দুই পর আসে টার্নিং পয়েন্ট। ২০১৬ সাল শুরু হয়েছিল জুনিয়র টেনিসের ১৪তম বাছাই হিসেবে। আর বছর শেষ হয় করেন্টিন মোতিতকে হারিয়ে জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। প্রথম গ্রিক খেলোয়াড় হিসেবে জিতেন জুনিয়র গ্র্যান্ড স্লাম, তাও আবার উইম্বলডন। সে বছর যতগুলো টুর্নামেন্ট খেলেছিলেন, সবগুলোর কোয়ার্টার খেলেই তবে ফিরেছেন।

ফেদেরারের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়াও অনেক বড় কিছু। ছবি: টুইটার
ফেদেরারের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়াও অনেক বড় কিছু। ছবি: টুইটার

সিনিয়র টেনিসে পা রাখেন ২০১৭ সালে। সে বছর থেকেই শুরু করেন এটিপি টুর্নামেন্টে যাত্রা। প্রথম নজরে আসেন ইউরোপিয়ান ওপেনে ডেভিড গফিনকে নিজের মাটিতে হারিয়ে। বেলজিয়ামের মাটিতে তাঁকে হারানো প্রায় অসাধ্য ব্যাপার বটে। সেখানে গফিনকে হারিয়ে নিজের আগমনী বার্তা জানান সিৎসিপাস। বছর শেষে শীর্ষ ১০০তে ঢুকে পড়েন সিৎসিপাস। বছর শেষের এ খবর একটা বার্তাই ছিল, পরের বছর নতুন চমক আসছে!

২০১৮ সালের শুরুতে কাতার ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনাল। অবাক করার মতো তেমন কিছু না হলেও নজর কাড়তে যথেষ্ট। বার্সেলোনা ওপেনে একটি সেটও না হেরে ফাইনালে। আলোচনায় এসেছেন আরেকটি কারণে, দ্বিতীয় পর্ব থেকে ফাইনাল পর্যন্ত হারিয়েছেন শীর্ষ ১০ বাছাইয়ের চারজনকে। তবে ফাইনালের প্রতিপক্ষকে লাল মাটিতে হারানো আর আকাশ ছুঁয়ে মাটিতে নেমে আসা, অনেকটা একরকমই। ‘এল ম্যাটাডোর’ খ্যাত রাফায়েল নাদালের কাছে হেরে শিরোপা বঞ্চিত থাকতে হলো তাঁকে। পরের সপ্তাহে আবার এসরিল ওপেনের সেমিফাইনাল। যে উইম্বলডনের মাটিতে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছেন ছোট বেলায়, সেই উইম্বলডনে প্রবেশ করলেন সরাসরি বাছাই হিসেবে। তবে চতুর্থ পর্বেই ‘অল ইংল্যান্ড কোর্ট’এর পাট চুকাতে হয়।

কানাডিয়ান ওপেনে আবারও চমক। জীবনে প্রথমবারের মতো মাস্টার্স ফাইনাল, সেটাও আবার শীর্ষ ১০ বাছাইয়ের চারজনকে হারিয়ে। যার মধ্যে রয়েছেন ডমিনিক থিম, কেভিন অ্যান্ডারসন, আলেক্সান্ডার জভেরেভ ও নোভাক জোকোভিচ! কিন্তু আবারও নাদালের কাছেই হার মানতে হয় তাঁকে। আরেকবার হাতছোঁয়া দূরত্বে শিরোপা রেখে ফেরত আসতে হয় তাঁকে। তবে গ্রিক রাজপুত্রকে বেশি দিন অপেক্ষায় রাখেনি। আর্নেস্তো গুলবিসকে হারিয়ে স্টকহোম ওপেনের শিরোপা নিজের করে নেন। বছরের শেষ নেক্সট জেনারেশন অ্যালেক্স ডি মিনাউরকে নিয়ে হারিয়ে আরেকটি শিরোপা হাতে নিয়ে।

নাদালকে হারাতে পারবেন কি সিৎসিপাস? ছবি: টুইটার
নাদালকে হারাতে পারবেন কি সিৎসিপাস? ছবি: টুইটার

টেনিস ফ্যানদের জন্য ‘নেক্সট জেন’ একটা হতাশার নাম। নাম নেওয়ার মতো অনেকেই এসেছে, হুটহাট বড় নামদের হারিয়ে দেওয়া অনেকের কাছেই নিয়মিত ব্যাপার। এরপর সেরা ২০-এ আগমন। তারপর শুরু হয় চাপ, চাপে ভেঙে পড়া, আর সামনে এগোতে না পারা। জভেরেভ থেকে ডমিনিক থিম, সবার গল্পটা এক ধাঁচেই গড়া। এক বছর টিকলে পরের বছর আর তাঁদের খোঁজ নেই। সিৎসিপাসকে সেরকম ‘ফ্লুক’ ভাবতে দোষ কোথায়? কিন্তু ‘ফ্লুক’ হতে তো আগমন ঘটেনি তাঁর। যারা ভেবেছিল তার আগমনও সে হারানোর জন্যই, তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, হারানোর জন্য নয়, জেতার জন্যই এসেছেন তিনি। প্রথম দেখায় হারিয়ে দিয়েছেন জোকোভিচের মতো তারকাকে, এবার সামনে পেয়ে গেলেন রজার ফেদেরারকে। একটুও ছাড় দিলেন না। নিজের আইডল, যাকে দেখে এত দিন শিখেছেন, তাঁকেই প্রতিপক্ষরূপে পেয়ে একটুও ঘাবড়ালেন না। বরং তাকেই বাড়ির পথ দেখিয়ে দিলেন, নিজে চললেন এগিয়ে। সামনে রাফায়েল নাদাল, ‘বিগ থ্রি’য়ের মুখোমুখি হয়ে শুধু তাঁর বিপক্ষেই জয় পাননি, এখন স্বপ্নটা তাঁকে হারানোর।

২০ বছরের জীবনে স্বপ্ন দেখেছেন অনেক কিছু নিয়ে, ইউটিউব চ্যানেল খুলেছিলেন নিজের ভ্লগ সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। নিজের ছোট ভাই-বোন নিয়ে একেকটা টুর্নামেন্ট খেলতে যেতেন আর ভ্লগ করতেন। একসময় উদ্দেশ্য ছিল ঘোরা আর টেনিস খেলা, সেখানে এখন উদ্দেশ্যটা পাল্টে এখন শিরোপা জেতা হওয়া উঠেছে। ইচ্ছে ছিল যদি টেনিসে সফলতা না পান, তবে মনোযোগ দেবেন ক্যামেরার পেছনে। হবেন সিনেমাটোগ্রাফার। কিন্তু এখন উল্টো সিনেমাটোগ্রাফারদের ক্যামেরা তাঁকে ঘিরে ধরছে। স্তেপানোস সিৎসিপাস এ আলো ধরে রাখবেন তো? না হারিয়ে যাবেন অন্য সব নেক্সট জেনদের মতো?