বিতর্ক থামিয়ে দিতে পারেন সাব্বিরই

সাব্বির রহমানের ব্যাট কথা বললে থেমে যাবে বাকি কথা। ছবি: প্রথম আলো
সাব্বির রহমানের ব্যাট কথা বললে থেমে যাবে বাকি কথা। ছবি: প্রথম আলো
>শাস্তি কমে গেছে, নিউজিল্যান্ড সিরিজের দলে ফিরেছেন সাব্বির। কিন্তু কে কমাল শাস্তি, কীভাবেই-বা এলেন দলে—এ নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল, বিতর্ক। এরই মধ্যে গত ৫ ম্যাচে ৪৭ গড়ে ১৮৮ রান করেছেন সাব্বির

সাব্বির রহমানের শাস্তি তাহলে কমাল কে? কীভাবেই-বা তিনি ঢুকে পড়লেন নিউজিল্যান্ড সফরের দলে? নতুন করে প্রশ্নগুলো উঠছে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের পরশুর বক্তব্যের পর। তিনি নাকি জানতেন, সাব্বিরের শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অথচ নিউজিল্যান্ড সফরের দল ঘোষণার দিনও শাস্তি বাকি ছিল ৩৭ দিন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ক্রিকেটপ্রেমীকে গালাগালি করায় গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর সাব্বিরকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কারের সুপারিশ করে বিসিবির শৃঙ্খলা কমিটি, যেটি শেষ হওয়ার কথা আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এরপর প্রায় চার মাস পেরিয়ে গেলেও সুপারিশ অনুমোদন হয়েছে কি না, সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি বিসিবি।

গত ২৩ জানুয়ারি ঘোষিত নিউজিল্যান্ড সিরিজের ওয়ানডে দলে সাব্বির সুযোগ পাওয়ায় বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন জানান, বিসিবি সাব্বিরের শাস্তির মেয়াদ এক মাস কমিয়েছে বলেই তাঁরা তাঁকে দলে নিয়েছেন। সঙ্গে এটাও জানান, বিশ্বকাপের কথা চিন্তা করে সাব্বিরকে নিউজিল্যান্ড সফরের ওয়ানডে দলে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। নির্বাচকেরা তাতে সম্মত হয়েছেন। ওই ধরনের কন্ডিশনে লোয়ার মিডল অর্ডারে সাব্বির ফাস্ট বোলারদের ভালো সামলাতে পারবেন, তাঁকে নেওয়ার পক্ষে এই যুক্তিও দেন মিনহাজুল।

দলের ভালোর জন্য অধিনায়ক একজন বিশেষ খেলোয়াড়কে চাইতেই পারেন। সেই খেলোয়াড় যদি কোনো কারণে বহিষ্কৃত থাকেন, অধিনায়কের অনুরোধ বিবেচনা করে ক্রিকেট বোর্ডও চাইলে কমিয়ে আনতে পারে সেই শাস্তির মেয়াদ। সাব্বিরের ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে। তা ছাড়া বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য নিউজিল্যান্ড সফরই আদর্শ সুযোগ। আর এমনও নয় যে শাস্তিটা অনেক বেশি কমানো হয়েছে। বহিষ্কৃত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি সিরিজই তিনি খেলতে পারেননি। এমনকি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ইমার্জিং কাপের দলের জন্য বিবেচনায় থেকেও শেষ পর্যন্ত সুযোগ পাননি ওই বহিষ্কারাদেশের কারণেই। শাস্তি কমিয়ে সাব্বিরকে নিউজিল্যান্ড সফরের দলে নেওয়াটা তাই কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো যেভাবে তাঁকে ফেরানো হলো, সেটি নিয়ে সৃষ্ট ধূম্রজাল।

মাশরাফি পরে বলেছেন, তিনি শুধু দলে সাব্বিরের প্রয়োজন বোধ করার কথা জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দুটিই ছিল শুধু নির্বাচকদের। সব মিলিয়ে সাব্বিরকে ফেরানোর সিদ্ধান্তের দায় নিতে গিয়েও যেন চলছে একধরনের চাপান-উতোর।

সূত্র জানিয়েছে, সাব্বিরের শাস্তি কমানোর সিদ্ধান্তটি ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান আকরাম খান, শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক, বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরীসহ বিসিবির অনেকে মিলেই নিয়েছেন। তাঁরা হিসাব করে দেখেছেন, সাব্বির যদি আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি নেপিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতেও খেলেন, তাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তাঁর বহিষ্কারাদেশ মাত্র ১৭ দিনই কমে। জাতীয় দলের স্বার্থে এটাকে ধর্তব্যের মধ্যে নিতে চাননি তাঁরা। কিন্তু সিদ্ধান্তে সমস্যা রয়ে যায় দুটি। প্রথমত, সাব্বিরের শাস্তি কমানোর বিষয়টি নিয়ে বিসিবি সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি বা তাঁর অনুমোদন নেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, এ ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেওয়া হয়নি আগে থেকে।

বিপিএলের ম্যাচ চলাকালীন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের প্রেসিডেন্ট বক্সে যখন বোর্ড সভাপতির কাছে নির্বাচকেরা খেলোয়াড় তালিকা অনুমোদনের জন্য নিয়ে যান, বিসিবির ওই কর্মকর্তারাও তখন সেখানে ছিলেন। জানা গেছে, খেলোয়াড় তালিকায় সই করার সময় সেখানে সাব্বিরের নাম দেখে সভাপতি জানতে চান তাঁর বহিষ্কারাদেশ শেষ হয়েছে কি না। উপস্থিত কর্মকর্তারা বোর্ড সভাপতিকে জানান, শাস্তির মেয়াদ শেষ। তাঁদের কথার ওপরই ভিত্তি করেই সভাপতি নিউজিল্যান্ড সফরের দলে সই করে দেন।

আরেকটি সূত্রের অবশ্য দাবি, নাজমুল হাসানকে তখন জানানো হয়েছিল যে সাব্বিরের শাস্তির মেয়াদ এক মাস কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যস্ততার মধ্যে তিনি হয়তো কথাটি ঠিকভাবে খেয়াল করেননি। বিসিবি সভাপতির পরশুর বক্তব্যেও এই দুই রকম সম্ভাবনাই আছে। সাংবাদিকদের নাজমুল হাসান বলেছেন, ‘যখন আমার কাছে খেলোয়াড় তালিকা সই করার জন্য আসে, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ওর (সাব্বিরের) শাস্তির ব্যাপারটা। শাস্তি শেষ হচ্ছে কবে। আমাকে বলেছে শাস্তি শেষ। হয়তো ভুল করে বলেছে বা হতে পারে মেয়াদটা কমিয়ে দেওয়াতে শাস্তি কমে গেছে।’

তবে সাব্বিরকে দলে নেওয়ার অনুরোধ ছিল, এটা স্পষ্ট করেই বলেছেন বোর্ড সভাপতি, ‘যখন বাদ দেওয়া হয়, তারপর অনেকবারই অনুরোধ এসেছে ওকে দলে নেওয়ার জন্য। আমরা সাধারণত এমনটা নিতে চাই না বা নিই না। কিন্তু অনেকেই মনে করে ওর পরিবর্তন হয়েছে। এটা অবশ্যই ওর জন্য শেষ সুযোগ। এরপরও যদি ওরকম করে, তাহলে জীবনেও আর খেলতে পারবে না।’ অধিনায়কের অনুরোধ, বোর্ড কর্মকর্তাদের শাস্তি কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং নির্বাচকদের সাব্বিরকে দলে নেওয়া; এসবের পরও নাজমুল হাসানের ব্যক্তিগত মতামত, ‘আমি মনে করি, আরও বেশি সময় নিয়ে, আরও বুঝেশুনে এলেই ওর (সাব্বির) জন্য ভালো হতো। ওর জন্য ঝুঁকিটা অনেক বেশি। একটা ছোট্ট ভুলে ওর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে।’

সাব্বিরের ঝুঁকিটা আরও বাড়ছে একেকজনের একেক রকম বক্তব্যে। পরিস্থিতি এমন যে তাঁকে দলে ফেরানো হলেও ফেরানোর দায়টা কেউই নিতে চাচ্ছেন না! উল্টো একেকজন দিচ্ছেন একেক রকম বক্তব্য, যাতে সার্বিক চাপটা গিয়ে পড়ছে সাব্বিরের ওপর। যাঁর দলে ফেরা নিয়ে অকারণেই এত বিতর্ক, তিনি ফিরেই ভালো খেলবেন, সে নিশ্চয়তা কি দেওয়া যায়?

সাব্বির ব্যাটে অবশ্য নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর প্রতিজ্ঞার ঝলক। এই বিতর্কের ডামাডোলেই গত ৫ ম্যাচে বিপিএলে করেছেন ১৮৮ রান, গড় ৪৭। এটা অবশ্যই সুখবর। তাঁর, বাংলাদেশের ক্রিকেটেরও।