বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ঘাসই শুধু জানে চান্দুর কষ্টের কথা!

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মোহাম্মদ চান মিয়া। ছবি: প্রথম আলো
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মোহাম্মদ চান মিয়া। ছবি: প্রথম আলো
চান্দু মিয়ার আড়ালে অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে আসল নাম মোহাম্মদ চান মিয়া। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রতিটা ঘাসের কাছে নিচু হয়ে কান পাতলেই যেন শোনা যায় গ্রাউন্ডসম্যান চান্দুর সুখ-দুঃখের গল্প।
ঘাস কাটছেন চান মিয়া। ফাইল ছবি
ঘাস কাটছেন চান মিয়া। ফাইল ছবি

দুপুরের সূর্যটা মাথার ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে। ভরদুপুরে তখনো ঘুমিয়ে আছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। কারও সঙ্গে এক–আধটু খোশগল্প করবেন—এমন মানুষের টিকিও নেই। তবে আছেন একজন। স্টেডিয়ামের অপর প্রান্তে প্রখর রোদের মধ্যে হাত ঘুরিয়ে সার ছিটিয়ে যাচ্ছেন ‘চান্দু মিয়া’। হাঁকডাক হলো, জবাব পাওয়া গেল না। তাঁর সব মনোযোগই ন্যাড়া হয়ে ওঠা হলদে ঘাসে। ঘাস সবুজ হয়ে উঠলেই যেন বাঁচবে তাঁর প্রাণ, হাসি ফুটবে মুখে। তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখগুলোর সঙ্গী যে ওই ঘাস।

পোশাকি পরিচয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের গ্রাউন্ডসম্যান। চান্দু মিয়ার আড়ালে অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে আসল নাম মোহাম্মদ চান মিয়া। বোঝার উপায় নেই বয়স ছাড়িয়ে গিয়েছে ৪৫। সারা দিন গায়ে–গতরে খাটার সুবাদে শরীরে মেদ–ভুঁড়ির লেশমাত্র নেই। বরং সুঠাম দেহটা চোখে আঙুল দিয়ে জানান দেয় চান্দুর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কথা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রতিটি ঘাসের কাছে নিচু হয়ে কান পাতলেই যেন শোনা যায় চান্দুর সুখ-দুঃখের গল্প।

স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে চান্দু মিয়ার পরিবার। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন ফুটবলার হওয়ার। খেলেছেন দ্বিতীয় বিভাগেও। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্লাব ও ফেডারেশনের ফুটফরমাশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। সময়ের পালাবদলে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দৈনিক লেবারের খাতায়ও উঠে যায় নাম। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সাবেক প্রশাসক ইয়াহিয়া খানের হাত ধরে ২০০৫ সাল থেকে পুরোপুরি স্টেডিয়ামের মাঠে সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে কাজের প্রশংসা। ফলস্বরূপ ২০১২ সালে গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে চাকরি হয় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম তাঁর বিচরণের প্রধান ক্ষেত্র হলেও যেখানেই বাফুফের টুর্নামেন্ট, মাঠ তৈরি করতে সেখানেই ছুটতে হয় তাঁকে। বদৌলতে সর্বসাকল্যে মাসিক বেতন পান ১৫ হাজার টাকা।

সকাল নয়টা থেকে শুরু হয় চান্দুর কাজ। শেষ হওয়ার সময়ের কোনো বালাই নেই। কিন্তু এ নিয়ে নেই কোনো আক্ষেপ, মাঠটাই যে তাঁর বাড়ি, ‘এই স্টেডিয়ামটাই আমার রুটিরুজি। আমার বউ–পোলাপান সবাই এই মাঠের ওপরেই নির্ভরশীল। তাই মাঠটাকেই নিজের বাড়ি ভাবি। সকালে আসি, রাতে যাই।’

সকাল থেকে রাত, ১১৫-৮০ গজ দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নিয়েই চান্দুর দুনিয়া। ঘাস লাগানো থেকে শুরু করে ঘাস কাটা, মাঠের দাগ রং করা, সবই তো তাঁর। ঘাস সবুজ হয়ে হাসলেই কেবল তাঁর আনন্দ। মাঠটা সমতল হলেই তাঁর মুখে স্বস্তি। কিন্তু এত কিছুর পরেও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। সেই কষ্ট পোড়ায় চান্দুকে, ‘মাঠটা ভালো করার জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী কোনো কিছুই বাদ দিই না। নিজের ছেলেমেয়েদের মতোই মাঠের যত্ন করি। কিন্তু কেউ যদি খেলায় হেরে গিয়ে মাঠের দোষ দেয়, খুব কষ্ট লাগে।’

চান্দু মিয়া মানেন, দেশের বাইরের মাঠের মতো নয় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মাঠ। কিন্তু বাস্তবতাও তো মানতে হবে। এক মাঠে কী না হয়। শাহরুখ খানের কনসার্ট থেকে শুরু করে খালি পায়ে ফুটবল। এর পরে কত ভালোবাসা দিয়েই না আবার ফিরিয়ে আনতে হয় মাঠের প্রাণ। তাই চান্দু মিয়া পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন অভিযোগকারীদের প্রতি, ‘হেরে গেলে মাঠের দোষ। কিন্তু কেউ জিতলে তো আর বলে না মাঠ ভালো। অথচ কোনো অনুষ্ঠানের পর মাঠটাকে খেলার উপযোগী করার জন্য আমাদের রাত-দিন এক হয়ে যায়। কেউ কি দেখে আমাদের কষ্ট?’

দেশে কমবেশি বড় ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়। চান্দু মিয়ার কাছে খালি নির্দেশ আসে, ‘অমুক তারিখ টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। মাঠটা হওয়া চাই একের (সেরা)।’ চান্দু মিয়ার মাথায় বাজ পড়ে, কপালে ফুটে ওঠে চিন্তার বলিরেখা। কারণ, খেলা শুরু বা শেষ নিয়ে আগাম কোনো তথ্যই ছিল না তাঁর কাছে। এরপর রাত–দিন এক করে চলতে থাকে মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি নিয়ে চান্দুর মাঠ তৈরির যুদ্ধ।

টুর্নামেন্ট শেষ হয়। কর্মকর্তাদের মুখে ফুটে ওঠে রাজ্য জয়ের হাসি। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সবার কপালেই জোটে ধন্যবাদবার্তা। অনেকের হাতে ওঠে বিশেষ বোনাসের খামও। কিন্তু চান্দু তো মাঠকর্মী। তাঁকে ধন্যবাদ জানাবেন কে?

কথাগুলো বলতে বলতেই মাঠের দিকে ফিরে তাকান চান্দু। বিদায় জানিয়ে দ্রুত হেঁটে গিয়েই হাতে তুলে নেন সার ও ভিটামিনের পাত্র। আবার ভালোবাসা দিয়ে শুরু করেন ঘাস সবুজ করার মিশন। শুধু ওই ঘাসগুলোই যে জানে তাঁর কষ্টের কথা।