'জিনিস' যেটা ভালো, দাম তার একটু বেশি

সতীর্থদের সঙ্গে দানিয়েল কলিন্দ্রেন্স। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সতীর্থদের সঙ্গে দানিয়েল কলিন্দ্রেন্স। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>মাসিক মাত্র ১১ হাজার ডলারের বিনিময়ে বসুন্ধরায় নাম লিখিয়েছেন কোস্টারিকান তারকা দানিয়েল কলিন্দ্রেস। ফেডারেশন কাপের ৬ ম্যাচে এক হ্যাটট্রিকসহ করেছেন ৫ গোল। স্বাধীনতা কাপের ছয় ম্যাচে করেছেন এক গোল। আর চলতি লিগের চার ম্যাচে তাঁর পা থেকে এসেছে দুই গোল। তবে নিজে গোল করার চেয়ে বরং সতীর্থদের দিয়ে গোল করানোর মধ্যেই তাঁর আনন্দ।

‘ভানে মাত্র একশ টাকা বাঁচাইতে গিয়ে তুমি লাগাইছ সাধারণ টিন, আর আমি লাগাইছি...। জিনিস যেটা ভালো, দাম তার একটু বেশি’, ঢেউটিন নিয়ে দেশের জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলের অংশ এটি। এই জিঙ্গেলের ভাবার্থটাই হতে পারে দেশের ক্লাব ফুটবলে বিদেশি খেলোয়াড় নির্বাচনের সেরা উদাহরণ। বসুন্ধরা কিংসের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে গলা মিলিয়ে অন্য ক্লাবগুলোর উদ্দেশে বলতেই পারেন, ‘হাজারখানেক ডলার বাঁচাতে গিয়ে তোমরা নিয়েছে সাধারণ মানের বিদেশি। আর আমরা নিয়েছি রাশিয়া বিশ্বকাপের খেলা খেলোয়াড়।’

কোস্টারিকার জার্সিতে রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা দানিয়েল কলিন্দ্রেসকে দলে ভিড়িয়ে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের একটা চমকই উপহার দিয়েছে নবাগত বসুন্ধরা। কলিনদ্রেসের পাখায় চড়ে দলটিও উড়ছে। ইতমধ্যে ক্লাবের হাতে তুলে দিয়েছেন স্বাধীনতা কাপের শিরোপা। টানা চার জয় নিয়ে শীর্ষে আছে লিগ পয়েন্টের টেবিলেও। প্রতিটি ম্যাচেই কলিনদ্রেস বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিশ্বকাপ খেলে ঢাকায় এসেছেন। টাকার মূল্যে দামটা তো তাঁর বেশি হবেই। সোজা বাংলায়, ‘যত গুড় তত মিষ্টি।’

কলিন্দ্রেসের দাম কি খুব বেশি? ফুটবল বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে মোটেও তা নয়। মাসিক মাত্র ১১ হাজার ডলারের বিনিময়ে বসুন্ধরায় নাম লিখিয়েছেন কোস্টারিকান তারকা। শুনে মনে হতে পারে অঙ্কটা অনেক। যেখানে মাসিক সাড়ে ৮ হাজার ডলারের বিনিময়ে নাইজেরিয়ার ডিফেন্ডার এলিসন উদোকা খেলছেন শেখ রাসেলে। ক্লাবগুলোতে ৮-৯ হাজার ডলার বেতনে বিদেশি খেলোয়াড় আছেন বেশ কয়েকজন। সুতরাং এই অঙ্কের সঙ্গে আরও কিছু যোগ করেই আনা যেতে পারে বিশ্বকাপের খেলোয়াড় তথা ভালো ফুটবলার। এ ছাড়া ৪ বিদেশির একজন বাদ (তিনজন নিবন্ধন) দিয়েও নেওয়া যেতে পারে ভালো মানের খেলোয়াড়। এতে দল তো উপকৃত হয়ই, দর্শকদের আগ্রহও যায় অনেক বেড়ে। বসুন্ধরায় তো সেই উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন।

ভালো মানের খেলোয়াড় বা কলিন্দ্রেসের জাদুর মোহনীয়তা অনেক। দল তো তাঁর কাছ থেকে সেরা সার্ভিসটা পাচ্ছেই, সঙ্গে শিখতে পাচ্ছেন স্থানীয় ফুটবলাররাও। মাঠে কলিন্দ্রেস কী করেন, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। কিন্তু মাঠের বাইরে মাহবুবুর রহমান সুফিল, তৌহিদুল আলম সবুজেরা যে পেশাদারির ছোঁয়া পাচ্ছেন তার দাম তো আরও বেশি। উদাহরণ দিয়েই খোলাসা করা যাক। ফেডারেশন কাপের ঘটনাবহুল ফাইনালে আবাহনীর কাছে হেরে শিরোপা হাতে তুলে নিতে পারেনি তারা। খেলা শেষে কলিন্দ্রেস সতীর্থদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমরা রানার্সআপ হওয়ার দল নয়। সবার কাছে অনুরোধ থাকবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রানার্সআপ ট্রফি নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করি। পরবর্তী টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েই ট্রফি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি শেয়ার করব।’

গোলের পর উড়ছে কলিন্দ্রেস। প্রথম আলো ফাইল ছবি
গোলের পর উড়ছে কলিন্দ্রেস। প্রথম আলো ফাইল ছবি

এরপরের গল্পটা তো সবারই জানা। স্বাধীনতা কাপের সেমিফাইনালে আবাহনীকে হারিয়ে নিশ্চিত করেছে ফাইনালের টিকিট। ফাইনালে শেখ রাসেলকে ২-১ গোলে হারিয়ে করেছে শিরোপা উল্লাস। এরপরেই হয়েছে ‘ভিক্টরি সেলিব্রেট।’ ইতিহাস বলবে স্বাধীনতা কাপে কলিন্দ্রেস গোল করেছেন মাত্র একটি। তথ্যটিতে কোনো ভুল নেই। কিন্তু গোলের ভিত্তিতে কী আর বিচার করা যাবে রাশিয়া বিশ্বকাপ তারকাকে। কখনো নম্বর নাইন, কখনো উইঙ্গার, ক্রমাগত ওপরে-নিচে ওঠানামা করে পুরো দলের খেলার সেতুটা গড়ে ওঠে তাঁর পা থেকেই। মূলত ফরোয়ার্ড কিন্তু গোল তৈরি করা কিংবা প্রয়োজনে রক্ষণে নেমে গোল ঠেকানো সব কটাতেই পারঙ্গম। নিজে গোল করার চেয়ে বরং সতীর্থদের দিয়ে গোল করানোর মধ্যেই তাঁর আনন্দ।

হ্যাঁ ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পায়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ঝলক নেই। কিন্তু খেলার মাঠটা যদি হয় যুদ্ধের ময়দান, তাতে ঢাকার মাঠে সবচেয়ে বড় বীরের নাম এখন কলিনদ্রেস। লড়াইয়ের সৌন্দর্যে আর সাফল্যে এক আশ্চর্য যুগলবন্দী এই কোস্টারিকান। মাঠের সীমানা ছাড়িয়েও তাঁর তাৎপর্য অনেক দূর। ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, শক্তিশালী দূতও।

তিনি যে বিশ্বকাপের ফুটবলার। তা ফুটে ওঠে ছোট বলে প্রতি স্পর্শে, প্রতি পাসে, প্রতি ড্রিবলিংয়ে, প্রতিটি ফিনিশিংয়ে। কী দুর্দান্ত অ্যাথলেট। তাঁর সঙ্গে গতিতে পেরে ওঠে না প্রতিপক্ষ। শক্তিতে থাকে পিছিয়ে। লম্বা পা ফেলে বল পায়ে এগিয়ে চলে যখন থামানোর উপায় নেই। দুই পা সমান কার্যকর। হেডে ভয়ংকর। পুরো মাঠ দেখতে পান হাতের তালুতে। অনবদ্য ভিশনে তাঁর পাস ঠিকঠাক খুঁজে নেই সতীর্থদের। আর দক্ষ দাবাড়ুর মতো তিনি যেন সব সময় পরের কয়েকটি চাল ভেবে রাখেন। তূণের ভেতর থেকে তাই কোন সময় কোন অস্ত্র বের করবেন বোঝা মুশকিল। বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলারের মধ্যে এই গুণগুলো থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

তবে সতীর্থরা যদি তাঁর গুণগুলোর মধু না খেতে পারতেন, তাহলেই হতে পারত সর্বনাশ। কলিন্দ্রেস দলের জন্য কী, তা সংজ্ঞায়িত করেছেন সতীর্থ মাহবুবুর রহমান সুফিল, ‘স্বাধীনতা কাপ জয়ের অন্যতম নায়ক কলিনদ্রেস। ফেডারেশন কাপ ফাইনালেও আমরা খেলেছি তাঁর ওপর ভর করে। ও আমাদের সঙ্গে খেলে দলের একজন হয়ে। ও ঢাকার মাঠের অন্য বিদেশিদের মতো স্বার্থপর নয়। ও দলের জন্য খেলে ও আমাদের খেলতে সহায়তা করে।’

একজনের মধ্যে এত গুণের সমাহার তো হবেই। ‘জিনিস’ যেটা ভালো, তার দাম একটু বেশি।