এই মুহূর্তে নিউজিল্যান্ড সবচেয়ে খারাপ দেশ

নিউজিল্যান্ডে প্রথম দুই ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। তামিম সে কারণে বেশ হতাশ। ছবি: উৎপল শুভ্র
নিউজিল্যান্ডে প্রথম দুই ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। তামিম সে কারণে বেশ হতাশ। ছবি: উৎপল শুভ্র
>

এগারো বছর আগে এই ডানেডিনেই তাঁর টেস্ট অভিষেক। এর দুই বছর পর একটা ওয়ানডেও খেলেছেন এখানে। আবারও সেই ডানেডিনে এসে অভিষেক টেস্ট ও নিউজিল্যান্ডে তাঁর আগের তিনটি সফর নিয়ে উৎপল শুভ্রকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন তামিম ইকবাল 

উৎপল শুভ্র: ডানেডিন শহরটা তো আপনাকে স্মৃতিকাতর করে তোলার কথা। এখানেই আপনার টেস্ট অভিষেক। এর আগে-পরের অনেক কিছু মনে পড়ছে না?
তামিম ইকবাল: ওই সিরিজে কিন্তু আমি একটা ম্যাচও না-ও খেলতে পারতাম। জাভেদ ভাই (জাভেদ ওমর) চোট পাওয়ায় প্র্যাকটিস ম্যাচটা খেললাম। অকল্যান্ডের ওই ম্যাচে আমি এক শ করে ফেললাম। ওই এক শর কারণেই মনে হয় আমি ওয়ানডে খেলেছি। প্রথম ম্যাচে ফিফটি করেছি, দ্বিতীয় ম্যাচে একটা ৪৩ রানের ইনিংস খেলেছিলাম। ওই সময় ফিফটি আর ৪৩ করলেই মোটামুটি সুপারস্টার! মনে রাখতে হবে, আমি ২০০৮-এর কথা বলছি।

শুভ্র:
ওয়ানডে সিরিজটা হয়েছিল ২০০৭ সালে...
তামিম: হ্যাঁ ২০০৭, কুইন্সটাউনে শেষ ওয়ানডের দিন নিউ ইয়ার ছিল। এরপরই শুনলাম যে, আমি টেস্ট টিমে থাকব। তখন ফিফটি আর ফোরটিই কত বড় ছিল, এ থেকেও তা বোঝা যায়। টেস্টে সুযোগ পেয়ে ভালো লেগেছিল। তবে খুব যে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, তা নয়। আমার মনে আছে, টেস্টে প্রথম আমার রান হলো বাউন্ডারি দিয়ে। লেগ সাইডে ফ্লিক করে বাউন্ডারি। ফিফটি করলাম। আমার টেস্ট অভিষেকের কিছু মনে রাখলে আমি দ্বিতীয় ইনিংসটা মনে রাখব। যখন ব্যাটিংয়ে নেমেছি, সম্ভবত ৪২ ওভার বাকি, একটু প্লাস-মাইনাস হতে পারে। আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিল, দিন শেষে নটআউট থাকা। এটা আমার জীবনে এর আগে খুব কম হয়েছে। নটআউট থেকে হোটেলে ফেরা, সকালে উঠে প্রিপারেশন নিয়ে যাওয়া-আমি এটি খুব এনজয় করেছিলাম। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল উত্তেজনায়। সকালে গিয়ে আবার ব্যাট করব, তার ওপর আবার সেঞ্চুরি করার সুযোগ (তামিম ৭২ রানে অপরাজিত ছিলেন)।

শুভ্র:
৮৪ রানে আউট হয়ে যাওয়া কতটা হতাশার ছিল?
তামিম: ৭৪, না ৮৪?

শুভ্র:
প্রথম ইনিংসে ৫৩, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৪...
তামিম: আমার এখনো মনে আছে, বলটা একটু লো হয়ে গিয়েছিল। কাইল মিলসের বলটা আমার ব্যাটের নিচের দিকে লেগেছিল। হতাশ তো হয়েছিলামই, এখানে তো বল ওভাবে লো হয় না। তবে মিথ্যা বলব না, সব মিলিয়ে আমি খুশিই ছিলাম। ৮৪ করেছি, এর আগে ফিফটি। ওই সময় তো ৩০-৩৫ রানই ৬০-৭০-এর মতো ছিল। ৬০-৭০ হানড্রেডের মতো। দ্বিতীয় টেস্টের আগের কয়েক দিন খুব ভালো লাগছিল। ভালো একটা সিরিজ খেলে দেশে ফেরার কথা ভেবে খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। দ্বিতীয় টেস্টেও ভালো ব্যাটিং করছিলাম, কিন্তু ১৫ রান করার পর ড্রাইভ করতে গিয়ে কাভারে ক্যাচ দিয়ে ফেললাম, আবারও মিলস।

শুভ্র:
এরপর হাতের আঙুল ভেঙে দ্বিতীয় ইনিংসে তো ব্যাটিংই করতে পারলেন না। দেশে ফিরলেন স্লিংয়ে হাত ঝুলিয়ে...
তামিম: সেটি তো খারাপ লেগেছিলই। তবে দেশে গিয়ে এয়ারপোর্টে আমাকে প্রেস কনফারেন্স করানো, পুরো জিনিসটা নিয়ে আই ওয়াজ ভেরি হ্যাপি, ভেরি এক্সাইটেড। নিউজিল্যান্ডে প্রথম ট্যুরের এটাই মেমোরি আর কী!

শুভ্র:
আজ যখন আবার ডানেডিনের সেই মাঠটায় গেলেন, বিশেষ কোনো অনুভূতি হয়নি?
তামিম: আমি এই মাঠে ওই টেস্ট ম্যাচের পর আরও দুইটা ম্যাচ খেলেছি। একটা ওয়ানডে আর যখন ওয়েলিংটন ফায়ারবার্ডসের জন্য খেলতে এসেছিলাম, তখন একটা ম্যাচ। আমার ঠিক মনে নাই, ওই ম্যাচে কত রান করেছিলাম। সত্যি কথা বললে, আমি এই মাঠে যখন যাই, আমার আলাদা কিছু মনে হয় না। হ্যাঁ, এই মাঠে আমার টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল, ভালো করেছিলাম। তবে এ নিয়ে বাড়তি কোনো রোমাঞ্চ টের পাই না। কোনো মাঠ নিয়েই আমার আলাদা কোনো আবেগ নেই। কারণ এমন কোনো মাঠ নেই, যেখানে আমি চাইলেই রান করতে পারি। সবাই লর্ডসের কথা বলে আমাকে। আমার জন্য স্পেশাল একটা মাঠ। এক অর্থে ঠিক, এই মাঠে সর্বশেষ টেস্টে আমি সেঞ্চুরি করেছি। তবে এরপর আমি সেখানে আরও তিনটা ম্যাচ খেলেছি, একটাতেও রান পাইনি। আমার কাছে সব মাঠই এমন-রান পেয়েছি, আবার পাইওনি।

শুভ্র:
নিউজিল্যান্ডে এর পরের দুটি ট্যুরের কথায় আসি। ২০১০ সালে তো একটাই টেস্ট। প্রথম ইনিংসে ৬৮ করেছিলেন ৭০ বলে, আর দ্বিতীয় ইনিংসে তো রীতিমতো পাগলামি করে ১৯ বলে ৩০, আউট হওয়ার আগে ৭ বলে ২২ রান...
তামিম: ওই সময় আমি অন্যভাবে ব্যাটিং করতাম। আমার মানসিকতাটাই ছিল আলাদা। ১৯ বলে ৩০ রানের কথা বলছেন, ওটা আমি প্ল্যান করে করিনি। আমি যখন দ্রুত রান করি, সেটা ন্যাচারালিই হয়ে যায়। যখন স্লো খেলি, তখনো ইট হ্যাপেনস ন্যাচারালি। এটা নির্ভর করে, ব্যাটিংয়ে নামার পর আমি কেমন ফিল করছি, হয়তো দুইটা শট লেগে গেল শুরুতে। তাহলে দেখা গেল তাড়াতাড়ি রান হয়ে যাচ্ছে। আমার ব্যাটিংয়ে প্ল্যানের চেয়ে বেশি কাজ করে রিদম। ১৯ বলে ৩০ করে আউট হয়ে গেছি দেখে মনে হতে পারে, ওটাই প্ল্যানিং ছিল। আসলে তা নয়।

শুভ্র:
দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য ছিল ৪০৪ রান। ওভাবে খেলার পর আপনাকে কারণ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘আমি তো এই টাইপেরই প্লেয়ার।’ শুনে আমার এমন রাগ হয়েছিল! লিখেছিলাম, ৪০৪ রান করার কাজটা পঞ্চম দিনের জন্য ফেলে না রেখে তামিম মনে হয় চতুর্থ দিনের ৩০ ওভারেই তা করে ফেলতে চেয়েছিলেন...
তামিম: আমি ওই সময় কী বলতে হয়, কী বলতে হয় না, বোঝার মতো পরিণত ছিলাম না। আর একটা সময় ছিল, যখন আমি ভাবতাম, সাংবাদিকেরা সবাই আমার শত্রু। এখন বুঝি, সাংবাদিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না হোক, একটা ভারসাম্য রেখে চলা যায়। জীবনের সব ক্ষেত্রেই চরম কিছু না ভেবে এই ভারসাম্য রাখাটা খুব জরুরি।

শুভ্র:
বাবা হওয়াটা কি কিছুটা ভূমিকা রেখেছে এতে?
তামিম: হয়তো...বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি অনেক কিছু শিখবেন। এখন আমি যা বলছি, পাঁচ বছর পরে হয়তো এর চেয়ে ভালো উত্তর দেব।

শুভ্র:
২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডে পরের সফরেও ওয়েলিংটনে ৫০ বলে ৫৬ রানের ঝোড়ো একটা ইনিংস খেলেছিলেন...
তামিম: ওই ইনিংসটা খুব মিনিংফুল ছিল। কন্ডিশনটা ছিল খুব কঠিন, বিশেষ করে প্রথম দিনের প্রথম দুই ঘণ্টা। সবুজ উইকেট, আমরা টসে হেরেছি, ঠান্ডা, প্রবল বাতাস...আমি বুঝে ফেলেছিলাম এই উইকেটে কিছু করতে হলে আমাকে আক্রমণাত্মক হতে হবে। এটা ভেবেই নেমেছিলাম। শুরুতেই কয়েকটা বল ব্যাটে লাগল, ওই ইনিংসটাতে আমি খুব ভালো ব্যাটিং করেছিলাম। সেঞ্চুরি করতে পারলে এটিই হয়তো আমার সেরা ইনিংস হতো। ওই সময়ে আমাদের যিনি কোচ ছিলেন-হাথুরুসিংহে-ওঁর সময়ে আমি অনেক ভালো ভালো ইনিংস খেলেছি, কিন্তু এটাকে তিনি সবার ওপরে রাখতেন। আমাকে বলেছিলেন, তুমি পুরো দলের মানসিকতাটা বদলে দিয়েছ।

শুভ্র:
ট্যুর করার জন্য নিউজিল্যান্ড কেমন লাগে আপনার?
তামিম: আমার খুব সহজ একটা সূত্র আছে-যেখানে আমি ভালো খেলি, সেটাই বিশ্বের সেরা শহর। যেখানে ভালো খেলি না, সেটি সবচেয়ে খারাপ। এ মুহূর্তে নিউজিল্যান্ড আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ দেশ। আগামী দুদিন পর কী হবে জানি না।

শুভ্র:
নিউজিল্যান্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের রেকর্ড এখন ১২-০। এটা কতটা কষ্ট দিচ্ছে?
তামিম: সিরিজ শুরুর আগে আমাকে আপনি জিজ্ঞেস করতেন, আমরা কী চাই, আমি উত্তর দিতাম, একটা ম্যাচ জিততে চাই এখানে। একটা ম্যাচ জিতে এই কুফাটা কাটানো দরকার। প্রথম দুই ম্যাচে তা তো হয়ইনি, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারিনি। এ কারণেই বেশি হতাশ। সব ম্যাচ হারলেও এখানে আমাদের গত সিরিজটা বরং ভালো ছিল। একটা ম্যাচ তো জেতারই কথা ছিল, অন্য আরেকটাতেও আমাদের সুযোগ ছিল।

শুভ্র:
নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের একটাই জয়। বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে আপনার ৯৫ রানের ইনিংসের কারণেই তিন শর বেশি রান তাড়া করে জিতেছিল বাংলাদেশ। নেলসনের ওই ৯৫-কেই কি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আপনার সেরা ইনিংস বলবেন?
তামিম: না-না-না। এর আগে আমার সঙ্গে যা হয়েছে, তাতে ৯৫ আমার জন্য খুবই বিশেষ একটা ইনিংস ছিল। আমি খুব ভালো ব্যাটিংও করেছিলাম। তবে তারপরও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আমার সেরা ইনিংস বলব ওয়েলিংটন টেস্টের ওই ইনিংসটাকে।