রোনালদো-জুভেন্টাসের স্বপ্ন হুমকির মুখে!

জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হবে তো? ছবি: এএফপি
জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হবে তো? ছবি: এএফপি
>

রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে জুভেন্টাস এনেছিলই একটা মাত্র কারণে, ২৪ বছর পর আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম লেগে যেভাবে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কাছে হেরে বসল তারা, এই মৌসুমে আদৌ সেই স্বপ্ন পূরণ হবে তো?

গত এক বছর ধরে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে সবচেয়ে যন্ত্রণা দিয়েছেন উরুগুয়ের খেলোয়াড়েরা।

বিশ্বাস হচ্ছে না? একটু ভেবে দেখুন, ভুল কিছু বলিনি। ফুটবল দুনিয়ার সম্ভাব্য সবকিছু জেতার পর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মূল লক্ষ্য এখন দুটি। এক - বিশ্বকাপ জেতা, দুই - রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়া অন্য কোনো ক্লাবের হয়ে এই বয়সে নিজেকে প্রমাণ করা (পড়ুন, জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করা)। এই দুটি লক্ষ্য পূরণে রোনালদোর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন উরুগুয়ের ফুটবলারেরা। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে এই উরুগুয়ের কাছেই ২-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল রোনালদোর পর্তুগাল। গতকাল চ্যাম্পিয়নস লিগেও উরুগুয়ের দুই ফুটবলারের জন্য দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম লেগ হারল রোনালদোরা। দ্বিতীয় লেগে নিজেদের মাঠে অবিশ্বাস্য কিছু করতে না পারলে মোটামুটি বলে দেওয়া যায় দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই এবার বিদায় নিচ্ছে জুভেন্টাস। অ্যাটলেটিকোর দুই উরুগুইয়ান ডিফেন্ডার ডিয়েগো গডিন ও হোসে জিমেনেজের গোলমুখো দুই শট আটকানোর সাধ্য ছিল না জুভেন্টাসের পোলিশ গোলরক্ষক ওজিয়েক শেজনির।

এই মৌসুমের শুরুতে ১০০ মিলিয়ান পাউন্ডের বিনিময়ে রিয়াল থেকে রোনালদোকে তুলে আনে জুভেন্টাস। উদ্দেশ্য মাত্র একটাই— সেটা হলো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ছোঁয়ায় জুভেন্টাস তাদের ২৪ বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগ-খরা কাটাবে, এমনটাই ভেবেছিলেন তুরিনের কর্তাব্যক্তিরা। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম লেগ হেরে সে স্বপ্নটাকে এই বছরের জন্য জলাঞ্জলি দিতে হবে, অবস্থা এমনই মনে হচ্ছে।

কিন্তু এমনটা কেন হলো? এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফেবারিট দলগুলোর মধ্যে জুভেন্টাসই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী, বলা যায়। গত তিনবারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ রোনালদোকে হারিয়ে ক্ষয়িষ্ণু, মার্সেলো-রামোস-বেল-ইসকো-মদরিচ রা গত মৌসুমের ছায়া হয়ে আছেন। পিএসজির আক্রমণভাগ সবচেয়ে শক্তিশালী হলেও সদ্য চোটে পড়া নেইমারকে ছাড়া কত দূর এগোতে পারবে, সেটিও প্রশ্নের বিষয়। তা ছাড়া পর্যাপ্ত সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার না থাকার কারণে পিএসজির মিডফিল্ডও দুর্বলই বলা চলে। গতবারের রানার্সআপ লিভারপুলের ফর্মের ঠিক নেই, কোনো ম্যাচ দুর্দান্তভাবে জিতছে, তো পরের ম্যাচেই অপ্রত্যাশিতভাবে হারছে বা ড্র করছে। ভালভার্দের অধীনে বার্সেলোনা অতিমাত্রায় মেসি-নির্ভর। যেদিন মেসি জ্বলে ওঠেন সে দিন বার্সাও জ্বলে ওঠে। মেসি নিষ্প্রভ থাকলে বার্সাও নিষ্প্রভ থাকে। সব মিলিয়ে বলা যায় জুভেন্টাস এবার সব দিক দিয়েই শক্তিশালী। কিয়েলিনি-বোনুচ্চি-বারজাগলির বজ্রকঠিন রক্ষণভাগের সঙ্গে মিডফিল্ডে মিরালেম পিয়ানিচের অলস সৌন্দর্য, ওপরে রোনালদোর গোলক্ষুধার সঙ্গে মানজুকিচের পরিশ্রম— এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে জুভেন্টাসকে ভালো ফেবারিটই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি ফেলে দিল অ্যাটলেটিকোর সেই উরুগুইয়ানরা!

এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে রোনালদোর অতি পরিশ্রমকে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিজেই মুখ ফুটে বলেছেন, জুভেন্টাসের হয়ে সম্ভাব্য সকল শিরোপা জিততে চান তিনি। এই ‘বুড়ো’ বয়সে এসে ভিন্ন লিগে নিজেকে প্রমাণ করার ভূত চেপেছে তাঁর মাথায়। নিজেই বলেছেন, পারলে লিওনেল মেসি স্প্যানিশ লিগ থেকে বের হয়ে তাঁর মতো ভিন্ন লিগে নিজেকে প্রমাণ করে দেখাক! এই লক্ষ্য পূরণ করার জন্য রোনালদো খাটছেন প্রচুর। রিয়ালের হয়ে শেষ দুই মৌসুমে কোচ জিনেদিন জিদান রোনালদোকে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে খেলাতেন, অনেক সময় ম্যাচ জয় নিশ্চিত হয়ে গেলে রোনালদোকে মাঠ থেকে তুলে নিতেন। প্রথম প্রথম জিদানের ওপর মন খারাপ করলেও পরে ঠিকই প্রতি ম্যাচ না খেলার এই বিষয়টা মেনে নিয়েছিলেন তিনি। স্প্যানিশ কাপ, কোপা দেল রে— এসব টুর্নামেন্টের অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ না খেলার কারণে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে রোনালদো থাকতেন আরও বেশি উদ্যমী, আরও বেশি ক্ষুধার্ত, আরও বেশি ঝরঝরে। এমনকি রোনালদোকে যেন বেশি খাটাখাটনি করে খেলতে না হয়, এ জন্য তাঁকে উইং থেকে সরিয়ে পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার বানিয়ে দিয়েছিলেন জিদান। ফলে পাকা শিকারির মতো শুধুই গোল করে যেতেন রোনালদো। কিন্তু জুভেন্টাসে এমনটা হচ্ছে না। সাসসুয়োলো-ফ্রসিনোনের মতো অগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন রোনালদো। হয়তো নিজেকে ভিন্ন লিগে প্রমাণ করতে চাওয়ার সেই অদম্য বাসনার কারণেই একটা ম্যাচেও বেঞ্চে বসে থাকতে চাইছেন না তিনি।

ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জুভেন্টাস। অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে ম্যাচটায় বলতে গেলে রোনালদোকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। বেশ বাজে খেলেছেন। খেলার মধ্যে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট ছিল। অতি উদ্যমী হয়ে প্রত্যেকটা ম্যাচ খেলতে গিয়ে উলটো নিজের জীবনীশক্তি কমিয়ে দিচ্ছেন না তো এই পর্তুগিজ তারকা? ভাবনার বিষয়! যদি সেটা হয়েই থাকে, জিদানের পথ অনুসরণ করার এটাই সময়। জুভেন্টাস কোচ মাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি কি সেটা বুঝতে পারছেন?

অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে নিজেদের মাঠে দ্বিতীয় লেগ খেলতে নামবে জুভেন্টাস, মার্চ মাসের ১৩ তারিখে। নতুন ক্লাবের চ্যাম্পিয়নস লিগ-স্বপ্নটা জিইয়ে রাখার জন্য নিজের ঝুলি থেকে কোনো জাদুমন্ত্রটা বের করবেন রোনালদো?