তামিম রোদজ্বলা সুন্দর!

সেঞ্চুরির পর তামিমের উদ্‌যাপন। ছবি: এএফপি
সেঞ্চুরির পর তামিমের উদ্‌যাপন। ছবি: এএফপি
>নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যামিল্টন টেস্টের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট ২৩৪ রানে। বাংলাদেশ ইনিংসের একমাত্র উজ্জ্বল দিক—তামিমের সেঞ্চুরি। বাঁহাতি ওপেনারের ১২৮ বলে ১২৬ রানের ইনিংসটা হ্যামিল্টনের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটার মতোই স্নিগ্ধ, সুন্দর

বলটা ডাক করতে গিয়ে পেরিস্কোপই করে ফেলেছিলেন প্রায়! উঁচিয়ে থাকা ব্যাটের কানায় লাগা বল ঘিরে ধরা ফিল্ডারদের মুখে চিৎকারের কোরাস তুলে দিল। ক্যাচ ইট! ভাগ্য ভালো, বল নিরাপদে ঘাস ছুঁল। টিম সাউদির পরের বলটাই তামিম ইকবাল মেরে দিলেন পয়েন্ট দিয়ে। সাউদি, বেশি বাড় বেড়ো না!

না, তামিম ইকবালের ব্যাটে আজ মাস্তানি নেই। আছে রাজার শাসন। রাজদণ্ড উঁচিয়ে যেন নির্বাসনে পাঠালেন একেকটা বলকে। তুমি কাভার দিয়ে বেরিয়ে যাও। তুমি পয়েন্ট দিয়ে। তোমাকে নির্বাসন দিলাম থার্ড ম্যানে।

এমন একটা ইনিংসে তিন অঙ্কের জাদুসংখ্যায় পৌঁছাতে তামিম বেছে নিলেন সেরা পথ। গতি-বাউন্স দিয়ে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভোগানো নিল ওয়াগনারকে পুল করে চার মেরে। সেঞ্চুরি! ক্যারিয়ারের নবম, বিদেশের মাটিতে চতুর্থ।

তবে তিন থেকে চার নম্বর সেঞ্চুরিতে যেতে তামিম সময় নিয়েছেন ৯ বছর। লর্ডস ও ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে টানা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরির সেই কীর্তির পর এই প্রথম দেশের বাইরে সেঞ্চুরি। তার মানে যে একেবারেই বাজে খেলছিলেন প্রতিপক্ষের মাঠে, তা–ও না। বিদেশের মাটিতে তাঁর ব্যাটিং গড় দেশের মাটির মতোই ছিল। আজ তো বিদেশের গড়টাই (৩৯) দেশের গড়কে (৩৮) ছাড়িয়ে গেল।

আরও একটা কারণে তামিম মনে করিয়ে দিলেন ইংল্যান্ড সফরের সেই দুই সেঞ্চুরি। শুরু থেকে আজও তামিম সমান আগ্রাসী ছিলেন। আগ্রাসী শব্দটার মধ্যে যে বুনো খ্যাপামি আছে, তা অবশ্য একেবারেই ছিল না। এমনকি ৩৭ বলে ফিফটি করছেন, এই তথ্যও বড় বিভ্রান্তিকর। অনায়াসেই তো খেললেন, যেন চার মারা কত সহজ!

১০০ বলে সেঞ্চুরি, তাও আশির ঘর পেরিয়ে একটু ধীর হয়ে গিয়েছিলেন বলে। না হলে টেস্টের প্রথম দিনের প্রথম সেশনেই তো সেঞ্চুরিটা হয়ে যায়! তা না হলেও বাংলাদেশ যে ২ উইকেটে ১২২ রান নিয়ে লাঞ্চে গেল, তামিমের সৌজন্যেই। বাংলাদেশের স্কোর আসলে ১ উইকেটে ১২১ ছিল, বিনা উইকেটে ৫৭।

৮৬ রানে অপরাজিত থেকে লাঞ্চে যাওয়া তামিম এরপর থেকে সতর্ক হয়ে গেলেন। ওয়ানডে সিরিজটা একেবারেই যা-তা গেছে। ৫, ৫, ০! নিউজিল্যান্ডকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ দেশ লাগছে বলে ঘোষণাও দিয়েছিলেন তখন। অথচ হাত বাড়াতেও হয় না, সৌন্দর্য নিজে থেকে এখানে এসে পায়ে লুটায়।

হ্যামিল্টনের সেই সৌন্দর্য এসে ভর করল তামিমের ব্যাটে। অদূরের হ্যামিল্টন পার্কে আগের দিন দেখে আসা অজস্র নাম না-জানা ফুলের নাম দিতে ইচ্ছে করল তামিমের একেকটি শটের নামে। ওই যে গোলাপি আভা ছড়ানো ফুলটা, ওর নাম দিলাম কাভার ড্রাইভ। বেগুনি ফুলটার নাম স্কয়ার কাট। মোরগের লাল ঝুঁটির মতো উদ্ধত সাহসী ফুলটার নাম দিলাম তামিমের পুল!

পুরো ইনিংসে গোটা তিনেক খুঁত আছে, সে তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুলেও থাকে। অবিমিশ্র সৌন্দর্য বলে তো কিছু নেই। পুরো ইনিংসে টিম সাউদির বলে সেই পেরিস্কোপের পাশাপাশি খুঁত আছে কলিন ডি গ্র্যান্ডহোমকে ফিরতি ক্যাচটা দিয়েও বেঁচে যাওয়া, ইনিংসের ১৮তম ওভারে, তামিম তখন ৬৫। গালিতে কেন উইলিয়ামসনের সহজ ক্যাচ বানিয়ে শেষ পর্যন্ত গ্র্যান্ডহোমই ফেরালেন, সেটাও আসলে তামিমের সবচেয়ে দুর্বল শটে।

তামিম আউট হলেন ১২৮ বলে ১২৬ রান করে। বাংলাদেশের স্কোর তখন ৫ উইকেটে ১৮০। বাকি চার ব্যাটসম্যানের সম্মিলিত অবদান ৫২। সব মিলে ২১টি চারের পাশে ১ ছক্কা। ৯০ রান এসেছে না-দৌড়ে! তামিমের ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসগুলোর একটি। আর সেই সেঞ্চুরি দিয়ে আবারও টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক হয়ে গেলেন। যাঁর সবশেষ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরিটি এসেছে গত জুলাইয়ে, সেন্ট কিটসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে।

এই নিউজিল্যান্ডেরই একজন প্রথম মাউন্ড এভারেস্টের উচ্চতায় পা রেখেছিলেন। সেই সাহসের মধ্যে একটা সৌন্দর্য ছিল নিশ্চয়ই। তামিমকে আবারও টেস্টের মুকুটটা পরতে দেখে বলতে ইচ্ছে করছিল, তামিম, আপনি বাংলাদেশের এডমুন্ড হিলারি। আর আজকের এমন ইনিংসেও পাশে কাউকে সেভাবে পেলেন না বলে, আপনি নিঃসঙ্গ শেরপাও।