হারিয়ে যাওয়া বাঘের দাঁত এবং সৌম্য

হ্যামিল্টনে টিম হোটেলে সৌম্য সরকার। ছবি: রতন গোমেজ
হ্যামিল্টনে টিম হোটেলে সৌম্য সরকার। ছবি: রতন গোমেজ

সেঞ্চুরি করার পর গলায় পরা সোনার চেইনটার লকেটে চুমু খেয়েছেন। কী ছিল সেটিতে? সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি, রাধাকৃষ্ণের ছবি আর ‘ওঁ’ লেখা একটা ছোট্ট ফলক। বছর দেড়েক আগে এগুলোর সঙ্গে আরেকটা জিনিসও ছিল। যেটি হারিয়ে গেছে বলে এখনো সৌম্য সরকারের খুব মন খারাপ। কী সেটা? বাঘের একটা দাঁত। 

সৌম্যর এক কাকার বাড়ি সুন্দরবনের কাছে। বাঘের দাঁতটা তিনিই এনে দিয়েছিলেন। ‘টাইগার’-এর গলায় বাঘের দাঁত-ভালোই মানিয়েছিল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ডাকনাম তো ‘টাইগার’-ই। সৌম্যর চেইনে লকেটের মতো বাঘের ওই দাঁতটা অবশ্য এ কারণে ছিল না। তাহলে কী কারণে?
সৌম্যর মুখেই শুনুন-
‘আমাদের অঞ্চলে মানুষ খুব তুকতাকে বিশ্বাস করে। আমাদের পরিবার একটু বেশিই করে। বাঘের দাঁত গলায় ঝোলানোর নাকি অনেক উপকার আছে। আমি সেটিকে লকেট বানিয়েছিলাম পিঠের ব্যথার কারণে। অনূর্ধ্ব-১৭ দলে খেলার সময়ই আমার পিঠে ব্যথা হতো। এই পিঠের সমস্যাটাকে আমাদের বংশগতই বলতে পারেন। আমার বাবা ফুটবলের গোলকিপার ছিলেন। ক্রিকেটও খেলতেন। আমার মেজ দাদা অনেক বছর ঢাকায় ক্রিকেট লিগে খেলেছেন। তাঁদের দুজনেরও ওই সমস্যা ছিল।’
পিঠের সমস্যা থেকে অনেক দিনই মুক্ত সৌম্য। তাতে ওই বাঘের দাঁতের কোনো ভূমিকা আছে কি না, এটা পুরোপুরিই বিশ্বাসের ব্যাপার। সৌম্য বিশ্বাস করতেন। অনেক দিন গলায় ছিল বলে সেটির প্রতি একটা মমতাও জন্ম নিয়েছিল। একদিন যখন দেখলেন, সেটি আর গলায় নেই, কোথাও পড়ে গেছে-তাঁর খুব মন খারাপ হয়েছিল। সৌম্যর গলায় এই বাঘের দাঁত আবিষ্কারের গল্পটা একদমই ঘটনাচক্রে। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সময় হঠাৎই একদিন টিম হোটেলে গলার লকেটটা দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘বলুন তো, এটা কী?’ দেখে পাথর-টাথর ভেবেছিলাম। বাঘের দাঁত তো কারও কল্পনাতেও আসার কথা না! পাথরের মতোই দেখতে হলুদাভ ওই লম্বাটে লকেটটার আসল পরিচয় জানার পর তাই মহা বিস্মিত। সেই বিস্ময় থেকে একটা ছবিও তুলে রেখেছিলাম। এর কিছুদিন পর আবারও সেটি দেখতে চাইতেই সৌম্য মুখটা কালো করে বললেন, ‘ওটা তো হারিয়ে গেছে।’
হ্যামিল্টন টেস্টে যে সেঞ্চুরিটা করেছেন, তাতে কাকাকে বললে আরেকটা বাঘের দাঁত হয়তো কোনো না কোনোভাবে ঠিকই জোগাড় করে দেবেন। টাকা দিলে নাকি বাঘের দুধও মেলে। আর এমন দুর্দান্ত একটা সেঞ্চুরিতে একটা বাঘের দাঁত মিলবে না!
পিঠের ব্যথা নিরাময়ে বাঘের দাঁতের ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে, তবে সৌম্যর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিতে যে সেটির কোনো ভূমিকা নেই, তা তো প্রমাণিতই। সেই সেঞ্চুরির পর প্রথম কী মনে পড়েছে? মনে পড়েছে এই মাঠেই আরেকটি সুখস্মৃতির কথা, ‘বিশ্বকাপে এখানেই আমি ওয়ানডেতে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করেছিলাম। সেদিনও রিয়াদ ভাইয়ের (মাহমুদউল্লাহ) সঙ্গে ভালো একটা পার্টনারশিপ হয়েছিল।’
আর সেঞ্চুরির আগে-৮৮ থেকে ছক্কা মেরে যখন ৯৪ রানে পৌঁছে গেলেন? ‘সেঞ্চুরির কথা খুব ভাবিনি। দলের যে অবস্থা ছিল, তাতে একটা জিনিসই চাইছিলাম, যত বেশি সময় সম্ভব যেন ব্যাটিং করতে পারি।’ ৯৯ রানে দাঁড়িয়ে সেটি একটু ভাবতেই হয়েছে, ‘রিয়াদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কী খেলব? সামনে বল পেলে মেরে দেব, নাকি ১ রানের চেষ্টা করব? রিয়াদ ভাই বললেন, “এটা টেস্ট ক্রিকেট। ধৈর্য ধর, রান নেওয়ার মতো বল ঠিকই পেয়ে যাবি। ”’
৯২ বলে ৯৯ হয়ে গিয়েছিল। পরের বলেই সেঞ্চুরিটা হলে টেস্টে বাংলাদেশের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা তাঁর হয়ে যায়। সেই বলটা ডট দেওয়ায় তামিমের রেকর্ডে শুধু ভাগ বসাতে পেরেছেন। সৌম্য অবশ্য এই রেকর্ডের কথা জানতেনই না, ‘লাঞ্চের সময় ড্রেসিংরুমে ফেরার পর তামিম ভাই বললেন, “কী রে, তুই কি আমার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিস নাকি? ” তামিম ভাইও মনে হয় নিশ্চিত ছিলেন না।’

সৌম্যর গলার সেই হারিয়ে যাওয়া বাঘের দাঁত: ছবি: উৎপল শুভ্র
সৌম্যর গলার সেই হারিয়ে যাওয়া বাঘের দাঁত: ছবি: উৎপল শুভ্র

প্রায় চার বছর আগে অভিষেকের পর দলে এমনই আসা-যাওয়া যে, হ্যামিল্টনের টেস্টটি ক্যারিয়ারের মাত্র ১৩ তম। সেটিতে ভালো করার একটা প্রতিজ্ঞা তো ছিলই, তবে এতটা ভাবেননি সৌম্য, ‘জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে সুযোগ পাইনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সুযোগ পেয়েও ভালো করতে পারিনি। এবার হঠাৎ যখন জানলাম, আমি টেস্ট দলে আছি, ভালো কিছু করতে চেয়েছিলাম। এমন না যে, সেঞ্চুরির কথাই ভেবেছিলাম।’ সেটি পেয়ে যাওয়ার পর এবার সৌম্যর লক্ষ্য, অধারাবাহিকতার বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসা। ক্রিকেটার মেজ দাদা পুষ্পেন সরকারও ফোনে এটাই বলেছেন তাঁকে, ‘দাদা প্রথমে বলেছেন, আর একটা রান করতে পারলেই তো ১৫০ হয়ে যেত। এরপরই হেসে বললেন, তখন অবশ্য মনে হতো, আর ৫০টা রান করলেই ডাবল সেঞ্চুরি! যাক, যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। অনেক কষ্ট করেছ। এবার এটা ধরে রাখো।’
পুষ্পেন যে কষ্টের কথা বলেছেন, স্কোরবোর্ডে সেটির প্রতিফলন নেই। ৯৪ বলে সেঞ্চুরি, ১৭১ বলে ১৪৯, যাতে ২১টি চার ও ৫টি ছয়-খেলা দেখে না থাকলে এটা আপনাকে জানাবে, সৌম্য সৌম্যর মতো স্ট্রোকের ফুলঝুরিই ছুটিয়েছেন। সেটি তো ছুটিয়েছেনই, না হলে চার-ছয়েই ১১৪ রান হয় কীভাবে! তবে সেটি তো শুধু ২৬টি বলের গল্প, বাকি ১৪৫টি বল তো সৌম্যর জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা নিয়েছে, ‘চার-ছয়ের মাঝখানে যে বলগুলো, সেগুলো অনেক কঠিন ছিল। এমন বোলিং তো আগে কখনো খেলিনি। ব্যাটিংয়ে এমন কষ্টও কখনো করিনি।’
টানা শরীরমুখী বোলিং সামলে খেলতে খেলতেই একটা বুদ্ধি এসেছে তাঁর মাথায়, সেটি কাজেও লেগেছে, ‘শর্ট বলগুলো ফাইন লেগের দিকে খেলতে চেষ্টা করেছি। স্কয়ার অব দ্য উইকেট খেললে ওই পেস আর বাউন্সে ক্যাচ উঠে যেতে পারত।’
বাবা-মা ভারতে বেড়াতে গেছেন বলে সেঞ্চুরির পর তাঁদের সঙ্গে খুব বেশি কথা হয়নি। বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে যেটি হয়েছে, তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রণব সরকারের সঙ্গে সেঞ্চুরির আগেও। তৃতীয় দিন শেষে ৩৯ রানে অপরাজিত সৌম্যকে সেই রাতে বলেছেন, ‘মনে রেখো, তুমি কিন্তু সাকিবের জায়গায় খেলছ।’ দায়িত্বটা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আর কী! যা শুনে সৌম্য বলেছেন, ‘তুমি অনেক বড় কথা বলছ, ওনার সঙ্গে কি আমার তুলনা চলে! আমি তো পরের ম্যাচে এখানেই খেলব কি না জানি না।’
আরেকটি বাঘের দাঁত সৌম্য পাবেন কি না, এ নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। তবে ওয়েলিংটন টেস্টে যে পাঁচেই নামছেন, তা নিয়ে বোধ হয় একটুও নয়।

হ্যামিল্টনে সৌম্যর ১৪৯

সময়২৫৫ মিনিট
বল১৭১
ছক্কা
চার২১
৩ রান
২ রান
১ রান১৭