চ্যাম্পিয়নস লিগে 'ফিরে আসা'র সপ্তাহ

উদ্যমী আয়াক্সের কাছে বশ মেনেছে টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ীরা। ছবি: এএফপি
উদ্যমী আয়াক্সের কাছে বশ মেনেছে টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ীরা। ছবি: এএফপি
>

রেফারির শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত ফুটবলে যে শেষ বলে কিছু নেই, এই অমোঘ সত্যটা এই সপ্তাহে যেন আরও ভালোভাবে প্রমাণিত হলো। চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম লেগ শেষে যে দলগুলো খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিল, তারাই দ্বিতীয় লেগে অবিশ্বাস্যভাবে জিতে জায়গা করে নিয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালে।

চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলাগুলি নিয়ে এ জন্য আগেভাগে কিছু বলতে নেই। কখন যে কি হয়ে যায়, কখন নিজের কথা নিজেরই হজম করতে হয়, নিশ্চয়তা আছে কোনো? চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ এ কারণেই একই সঙ্গে অপ্রত্যাশিত, ও সুন্দর। শেষ হয়েও যেন শেষ নয়। অন্তত রেফারির শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত তো অবশ্যই নয়। আর এই কথাটি প্রমাণ করার মঞ্চ হিসেবে এই সপ্তাহকেই বেছে নিল আয়াক্স আমস্টার্ডাম, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও এফসি পোর্তো।

এ সপ্তাহে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচ খেলতে নেমেছিল আটটি দল। রিয়াল মাদ্রিদ-আয়াক্স আমাস্টার্ডাম, টটেনহাম-বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, পিএসজি-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও এফসি পোর্তো-এএস রোমা। চার ম্যাচের মধ্যে তিনটিই দেখেছে অপ্রত্যাশিত ‘কামব্যাক’। প্রথম লেগে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পরেও নিজেদের ওপরে আস্থা রেখেছিল আয়াক্স, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও এফসি পোর্তো। আর এই আস্থা রাখার পুরস্কার তারা পেয়েছে পরের রাউন্ডে উঠে।

রিয়াল মাদ্রিদ ও আয়াক্সের মধ্যকার ম্যাচ দিয়েই শুরু করা যাক। টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী দল বনাম তারুণ্যে ঠাসা এক দল। সেই ক্রুইফ-নিসকেন্স বা ক্লাইভার্ট-রাইকার্ডদের মতো শক্তিশালী না হলেও, প্রতিভার দিক দিয়ে আয়াক্সের এই দলটি পিছিয়ে নেই মোটেও। দুই দলের মধ্যকার প্রথম ম্যাচেই এই প্রতিভার হালকা- পাতলা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। নিজেদের মাঠে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ীদের সঙ্গে সমানে সমান লড়েছিল আয়াক্স। ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, দুসান তাদিচ আর ম্যাথিস ডি লিটদের নিয়ে গড়া দলটা শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে হেরে যায়। করিম বেনজেমা আর মার্কো এসেনসিওর গোলে প্রথম লেগে প্রতিপক্ষের মাঠ থেকে দুটি মহামূল্যবান ‘অ্যাওয়ে গোল’ সহ জয় নিয়ে বার্নাব্যুতে ফেরে রিয়াল। জয় পাওয়া হয়ে গেছে, সঙ্গে অর্জিত হয়েছে মহার্ঘ দুটি অ্যাওয়ে গোল। তাই নিজেদের মাঠে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বিতীয় লেগকে অতটা পাত্তা দেয়নি তারা। রিয়াল পরের রাউন্ডে ওঠার ব্যাপারে যে কতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল, সেটা বোঝা যায় দলের অধিনায়ক সার্জিও রামোসের একটা কীর্তির মাধ্যমে। কীর্তি না বলে কুকীর্তি বললেই হয়তো বেশি ভালো হবে। যেভাবে তিনি খেলেন, নিয়মিত কার্ড দেখাটাই স্বাভাবিক। এটা রামোস নিজেও জানেন। এমনিতেই একটা হলুদ কার্ড পেয়ে বসা রামোস জানতেন, আয়াক্সের বিপক্ষে দ্বিতীয় লেগে যদি আরেকটা হলুদ কার্ড দেখেন, কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগটা আর খেলতে পারবেন না তিনি। প্রথম লেগ যেহেতু জেতা হয়েই গেছে দুটি অ্যাওয়ে গোল নিয়ে, দ্বিতীয় লেগে নিজেদের মাঠে আয়াক্সকে হারিয়ে বা ড্র করে কোয়ার্টারে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। ফলে প্রথম লেগের শেষ দিকে আয়াক্সের স্ট্রাইকার ক্যাসপার ডলবার্গকে অযথা ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখে বসেন তিনি। যাতে পরের লেগে না খেলা হয় হোক, কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগ যেন মিস না যায়! এত কিছু জানলেও রামোস যে জিনিসটা জানতেন না, সেটা হলো তাঁকে ছাড়া তার দলের রক্ষণভাগের কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না। আর সেই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে হাজার হাজার রিয়াল সমর্থকদের সামনে আয়াক্স রচনা করল এক মহাকাব্য। দুসান তাদিচ, ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, হাকিম জিয়েখ ও ডেভিড নেরেসদের জাদু মাঠে বসে বসে দেখে গেলেন মদরিচ-ক্রুস-বেনজেমারা। রামোসও দেখলেন, তবে মাঠের বাইরে ভিআইপি বক্সে বসে বসে। আরও দেখলেন তাঁকে ছাড়া তাঁর দলের রক্ষণভাগ কেমন নখদন্তহীন হয়ে পড়ে! রিয়ালকে তাদের মাঠেই ৪-১ গোলে হারিয়ে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৩ স্কোরলাইন নিয়ে কোয়ার্টারে চলে গেল আয়াক্স! কে ভেবেছিল প্রথম লেগে দুটি অ্যাওয়ে গোল উপহার দিয়ে ম্যাচ হেরে যাওয়ার পরেও দ্বিতীয় লেগে চ্যাম্পিয়নস লিগের বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের মাঠে গিয়ে তাদের এভাবে অপদস্থ করে আসবে আয়াক্স?

আগের দিন প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে আয়াক্সের মহাকাব্য রচনা করা দেখে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেরও সাধ হলো কিছু করার। দলে এখন কোচ হিসেবে হোস মরিনহো নেই, আছেন ওলে গুনার সুলশায়ার। খেলোয়াড়ি জীবনে যার শেষ কথা ছিল হারের আগে হার মেনে না বসা। প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ২-০ গোলে হেরে বসার পরেও সুলশায়ার আস্থা রেখেছিলেন নিজের শিষ্যদের প্রতি। সে আস্থার প্রতিদান কি ভালোভাবেই না দিলেন র‍্যাশফোর্ড-লুকাকুরা! আর সেই আগুনে ঝলসে গেলেন নেইমার-কাভানি-এমবাপ্পে-ডি মারিয়ারা। প্রথম লেগে ২-০ গোলে হারার পর কোয়ার্টার ফাইনালে উঠতে চলে পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করা লাগত ইউনাইটেডের। কিন্তু পাহাড় তো আছেই অতিক্রম করার জন্য! সুলশায়ার জানতেন সেটা। আর সেই মন্ত্রেই দীক্ষিত করেছিলেন তাঁর শিষ্যদের। চোট আক্রান্ত দল নিয়ে সেই ইউনাইটেডই পিএসজির মাঠ থেকে ৩-১ গোলের এক অবিশ্বাস্য জয় নিয়ে আসল! অ্যাওয়ে গোলের কেরামতিতে নেইমাররা নন, পরের রাউন্ডে চলে গেলেন লুকাকুরা। চোটে আক্রান্ত নেইমার মাঠের বাইরে থেকে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না! বার্সেলোনায় মেসির ছায়া থেকে বের হয়ে এসে একা কিছু করতে চেয়েছিলেন পিএসজিকে নিয়ে, নেইমারের এই আশা পরপর দুইবার ধাক্কা খেল চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডেই। আর অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে এসে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ২-১ গোলে জিতেছিল এএস রোমা। সে ম্যাচে নিকোলো জানিওলোর জোড়া গোলে ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও ম্যাচের শেষদিকে আদ্রিয়ান লোপেজ পোর্তোকে একটা মহামূল্যবান ‘অ্যাওয়ে গোল’ এনে দেন। নিজেদের মাঠে হবে দ্বিতীয় লেগ। নিজেদের মাঠে রোমাকে হারাতে পারবেন, এমন বিশ্বাস ছিল কিংবদন্তি গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াস ও তাঁর বর্তমান সতীর্থদের। দ্বিতীয় লেগে নিজেদের মাঠে রোমাকে ৩-১ গোলে হারিয়ে সে বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপান্তরিত করলেন টিকিনহো, মুসা মারেগা ও অ্যালেক্স তেয়েস রা।

আর বিশ্বব্যাপী ফুটবল ভক্তদের জানিয়ে দিলেন, শেষের আগে শেষ বলো না। হারের আগে হেরে যেও না!