জিদান ফিরলেন, রোনালদোও কি ফিরবেন?

দলের পুরো কর্তৃত্ব চাই, এমন শর্তেই রিয়ালে ফিরেছেন জিদান। ছবি: এএফপি
দলের পুরো কর্তৃত্ব চাই, এমন শর্তেই রিয়ালে ফিরেছেন জিদান। ছবি: এএফপি
>

তারার হাট ভেঙে এই মৌসুমের শুরুতে রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন জিদান আর রোনালদো। নয় মাস যেতে না যেতেই জিদানকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে আবারও রিয়ালের ডাগআউটে নিয়ে এসেছেন সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। গুরু তো আসলেন, গুরুর দেখাদেখি জুভেন্টাস থেকে রোনালদোও কি চলে আসবেন?

জিদান সব সময়েই বলে এসেছেন, ক্লাবের ভালোর জন্যই তিনি রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়েছেন। এমনকি গতকাল আবার যখন রিয়ালে ফেরত এলেন, বলেছেন একই কথা। জিদান নিজে যা-ই বলুন, আসল ঘটনা হলো রিয়ালের সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সঙ্গে দলবদল নিয়ে একমত না হতে পারার কারণেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন জিদান। জিদান চেয়েছিলেন গ্যারেথ বেলকে বিক্রি করে রোনালদোকে ঘিরে দল সাজাতে। আর ওদিকে পেরেজ ভেবেছিলেন রোনালদোর সময় শেষ, দল গঠন করা হোক বেলকে ঘিরেই। জিদান যাওয়ার নয় মাসের মধ্যেই দলের দুরবস্থা দেখে মতি ফিরেছে পেরেজের, বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে ফিরিয়েছেন জিদানকে। এখন প্রশ্ন হলো, রোনালদোও কি ফিরবেন?

গতকাল জিদানের সংবাদ সম্মেলনেও অবধারিতভাবে প্রশ্নটা উঠেছিল। আর তখন সকল জল্পনা-কল্পনায় এক রকম পানি ঢেলেছেন এই ফরাসি কিংবদন্তি, ‘আমার মনে হয় এই বিষয় (রোনালদোর ফেরা) নিয়ে কথা বলার সময় এখন না। আমাদের এখনো লিগে ১১ ম্যাচ খেলতে হবে, আগে সে দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। তারপর আমরা সামনের মৌসুম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা শুরু করব। আমরা ক্রিস্টিয়ানো সম্পর্কে জানি, ক্লাবের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের একজন সে। কিন্তু আজকের দিনটি সেসব নিয়ে কথা বলার সময় না।’

ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। রোনালদোকে রিয়ালের জার্সি গায়ে আবার দেখার আশা করে লাভ নেই। রিয়াল ছাড়ার পরে জিদান কার্যত বেকার ছিলেন। অন্য কোনো ক্লাবের দায়িত্ব নেননি। শুয়ে, বসে, খেলা দেখে কাটিয়ে দিতেন সময়। ফলে ‘বেকার’ জিদানকে ফিরিয়ে আনতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি রিয়ালের।

কিন্তু এই কথাটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বেলায় আবার খাটে না। রোনালদো তো বেকার নন! উল্টো নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় বানিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে রোনালদোকে নিয়ে এসেছে জুভেন্টাস। রোনালদোকে ঘিরেই এখন জুভেন্টাস কোচ ম্যাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি তার দল সাজান। জুভেন্টাসে গিয়েও একই ভাবে আলো ছড়াচ্ছেন রোনালদো। ফলে চাইলেই রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদে চলে আসবেন, এমন আশা করাটা বোকামি। তার ওপর রিয়াল সভাপতির সঙ্গেও রোনালদোর সম্পর্ক আগের মতো নেই। পেরেজের কাছে আগের মতো গুরুত্ব পান না দেখেই রিয়াল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রোনালদো। রোনালদো বহু চেষ্টা করেও পেরেজকে বলে নিজের বেতন মেসি-নেইমারদের সমান করতে পারেননি।
রিয়াল সভাপতির সঙ্গে জিদানের সম্পর্কও শেষ দিকে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আগে যেটা বললাম, জিদান চাননি তাঁর দলে বেল থাকুক। তিনি আগেই বুঝেছিলেন, এই স্কোয়াড তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে পৌঁছে গেছে। আর শিখরে পৌঁছে যাওয়ার পর শুধু একদিকেই যাওয়া যায়, নিচের দিকে। এটা জিদান বুঝেছিলেন। ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে জিদান অনুরোধ করেছিলেন গ্যারেথ বেলকে ছেড়ে দিয়ে হলেও রোনালদোকে রেখে দেওয়া হোক। কিন্তু সে অনুরোধে কাজ হয়নি। ২০১৩ সালে দলবদলের বাজারে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে আনা ওয়েলশ তারকাকে ঘিরে রিয়াল সাজাতে চেয়েছিলেন পেরেজ। রোনালদোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। ফলে ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি বুঝতে পেরেছিলেন, রিয়ালের মেরুদণ্ড ক্ষয়ে গেছে। রোনালদো না থাকলে সেটা আর আড়াল করা যাবে না। তাই মানে মানে কেটে পড়েছিলেন। রিয়ালের দলবদল সংক্রান্ত কার্যক্রমে জিদান সর্বময় ক্ষমতায় অধিকারী থাকবেন না, জিদানের ক্লাব ছাড়ার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ ছিল। জিদান যে ভুল ছিলেন না, এই মৌসুমের প্রতি মুহূর্তে সেটা বুঝতে পেরেছে রিয়াল।
ফলে এখন যেহেতু জিদান চলে এসেছেন, ধরেই নেওয়া যায় রিয়াল স্কোয়াড ও দলবদল নিয়ে তাঁর কথাই শেষ কথা হবে এমন আশ্বাস পেরেজ তাঁকে দিয়েছেন। পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন জিদান। যে সংবাদটা দলের বেশ কিছু তারকার জন্য সুখকর নয়। এদের পুরোভাগে অবশ্যই গ্যারেথ বেল। প্রায় ছয় বছর রিয়ালে আছেন, তাও এখনো পর্যন্ত স্প্যানিশটা ঠিকঠাক বলতে পারেন না। দলের বাকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও নেই তাঁর। দলের বাকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে এক সঙ্গে কোথাও খেতে যান না, ঘুরতে বের হন না। কিছুদিন আগে রিয়ালের গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া জানিয়েছেন এটা। ফলে জিদান আসা মানে বেলের বিদায় এক রকম নিশ্চিত। জিদানের পরিকল্পনার সঙ্গে খাপ না খাওয়াতে পারা কলম্বিয়ার তারকা হামেস রদ্রিগেজও বায়ার্নের সঙ্গে ধার চুক্তি শেষ হলে রিয়ালে ফিরছেন না, এটাও বলা যেতে পারে।

জিদান আসার ফলে আরও একজন তারকা মুখ কালো করে বসে থাকতে পারেন, তিনি নেইমার। বহুদিন ধরেই নেইমারের প্রতি রিয়াল আগ্রহী। আগ্রহ থাকার পরেও যে নেইমারকে ক্লাবে আনতে পারেনি, তার পেছনেও এই জিদানই ছিলেন। জিদান এমন কাউকে দলে চাননি যে মাঠের ভেতরের কাজ দিয়ে খবর হওয়ার চাইতে মাঠের বাইরের কাণ্ডকারখানা দিয়ে খবরের শিরোনাম হতেই বেশি আগ্রহী। জিদান চলে যাওয়ার পরে নেইমারের রিয়ালে আসার সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছিল একটু হলেও। নেইমার ও তার বাবাও দুই দিন পর পর রিয়ালে যাওয়া না যাওয়া, পিএসজি ছাড়া না ছাড়া নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে সংবাদপত্রগুলোকে খবরের জোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিদান ফিরে আসার ফলে বলা যায়, এমনটা হচ্ছে আর আর।

দলবদল সংক্রান্ত সকল বিষয়ে জিদান সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েই রিয়ালের সঙ্গে আবারও তিন বছরের চুক্তি করেছেন, এটা এখন বোঝা যাচ্ছে। শোনা গেছে, দলকে ঢেলে সাজানোর জন্য জিদানের হাতে ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ড দিতে প্রস্তুত পেরেজ। যে টাকা দিয়ে রোনালদোর একজন আদর্শ বিকল্প নিয়ে আসবেন জিদান। সেটা চেলসির বেলজিয়ান উইঙ্গার এডেন হ্যাজার্ডও হতে পারেন, আবার পিএসজির ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেও হতে পারেন।

জিদান-রোনালদো যাওয়ার পর দলের বেশ কিছু খেলোয়াড় মূল একাদশ থেকে জায়গা হারিয়েছিলেন। যারা জিদানের দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। যেমন মার্সেলো, ইসকো। সোলারির আমলে এই দুজন ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন মূল একাদশ থেকে। শোনা যাচ্ছিল, ক্লাব ছাড়তে পারেন তারা। জিদান আসার অর্থ হলো, মার্সেলো ও ইসকোর কাউকে আর রিয়াল ছাড়তে হবে না। আর ফর্মে থাকা ইসকো যে রিয়ালের কত বড় অস্ত্র হতে পারে, সেটা জিদানের অধীনে বেশ কয়েকবার দেখিয়েছেন তিনি।

‘নিয়মিত জেতার জন্য পরিবর্তন আনতে হবে দলে’— জিদান যে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন, সে পরিবর্তন আনার সবচেয়ে বড় মাধ্যম তিনি নিজেই।