অধিনায়কত্ব যখন বিষম বোঝা!

অধিনায়কত্ব মাঝে মাঝে শাস্তির মতো মনে হয়, মাহমুদউল্লাহ এটি বুঝতে পারছেন। ছবি: এএফপি
অধিনায়কত্ব মাঝে মাঝে শাস্তির মতো মনে হয়, মাহমুদউল্লাহ এটি বুঝতে পারছেন। ছবি: এএফপি
>

মাহমুদউল্লাহর কাছে অধিনায়কত্বটা কী বোঝা মনে হচ্ছে?

অধিনায়কত্বটাকে কি বিষম বোঝা মনে হচ্ছে মাহমুদউল্লাহর! সংবাদ সম্মেলনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণের মুখে পড়ে কখনো কি মনে হচ্ছে, ‘আমি এখানে কী করছি! এটা তো সাকিবের কাজ, আমার কী দায় পড়েছে সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার!’
মনে মনে এটাও বলে থাকতে পারেন, ‘আমি তো আমার যথাসাধ্য করছি। হ্যামিল্টনে দ্বিতীয় ইনিংসে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থায় সেঞ্চুরি করেছি। এখানেও তো আজ একাই লড়ে গেলাম। আমাকে কেন এসব অপ্রিয় প্রশ্নের জবাব দিতে হবে?’
হয়তো বলেছেন। হয়তো বলেননি। মনের কথা কি আর পড়া যায় নাকি! তবে ওয়েলিংটন টেস্ট শেষে সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদউল্লাহকে দেখে অনেকবারই মনে হলো, ‘আহা রে বেচারা! কী একটা বিপদেই না পড়েছেন!’ টেস্ট শেষ হওয়ার পর মাঠে আনুষ্ঠানিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাইমন ডৌলের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন টেলিভিশনে দেখে এসেছি। নতুন আর কী বলবেন তিনি!
বেসিন রিজার্ভে যেখানে মিডিয়ার লাঞ্চ করার জায়গা, সংবাদ সম্মেলনও সেখানেই হয়। সেটি আন্ডারগ্রাউন্ডে। এক তলা নিচের ইনডোর নেটে। বাংলাদেশের মতো মহা আনুষ্ঠানিক কিছু নয়। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের মিডিয়া বিভাগের দায়িত্বে থাকা দুই কর্মকর্তা স্পনসরদের নামসংবলিত ব্যাকড্রপটা টাঙিয়ে দেন, সেটির সামনে দাঁড়িয়েই সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন ক্রিকেটাররা। আগের দুই দিন এভাবেই কথা বলে গেছেন বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হয়ে আসা লিটন দাস ও তামিম ইকবাল; নিউজিল্যান্ডের নিল ওয়াগনার ও রস টেলর।
বিপত্তিটা হলো কাল আগেভাগে টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ায়। সংবাদ সম্মেলন আর লাঞ্চের সময় যে মিলে গেছে! সাংবাদিক এখানে খুব বেশি নয়। গত বেশ কয়েক বছরের মধ্যে কোনো সফরে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে কম সাংবাদিক আসার রেকর্ডই গড়ে ফেলেছে এই সিরিজ। টেলিভিশনের চারজন, প্রিন্ট মিডিয়ার দুজন। বিসিবির ফটোগ্রাফার আর ক্রিকইনফোর বাংলাদেশি প্রতিনিধিকে ধরলেও সংখ্যাটা হয় মাত্র ৮। গত ছয়-সাত বছরে বাংলাদেশের যেকোনো সফরের সঙ্গে তুলনা করলে যা কিছুই নয়। এর সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের চার-পাঁচজন।
সাংবাদিক কম থাকতে পারেন। কিন্তু টেলিভিশনের লোকজন-ধারাভাষ্যকার, ক্রু, শব্দ প্রকৌশলী সবার খাওয়ার জায়গা তো একটাই। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা তো কম নয়। টেস্ট শেষের সংবাদ সম্মেলন তাই আগের দুই দিনের জায়গায় নয়। বেসিন রিজার্ভে ঢুকতেই ডানে যে রুমটা পড়ে, সেখানে। বাঁয়ে ঐতিহ্যবাহী লং রুম। লর্ডসের লং রুমের অনুকরণে নিউজিল্যান্ডের প্রতিটি টেস্ট ভেন্যুতেই যা আছে। যেখানে শুধু নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট আর স্থানীয় ক্রিকেট সংস্থার লোকজনের প্রবেশাধিকার। অনেকটা বাংলাদেশের বিভিন্ন ভেন্যুতে প্রেসিডেন্টস বক্সের মতো। পার্থক্য বলতে, বাংলাদেশে খেলা হলেই যেমন দুই ওভারের মাঝখানে অকারণে ক্যামেরা প্রেসিডেন্টস বক্সে চলে যায়, বোর্ড সভাপতি এলে কখনো কখনো ওভারের মাঝখানেই, এখানে সেই বালাই নেই। এখানে খেলাটাই মুখ্য, কারও চেহারা দেখানো নয়।
প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করে গেলেন টিম সাউদি। উইলিয়ামসন কেন নয়? কারণ এসব দেশে এই সৌজন্যটুকু আছে। কেন উইলিয়ামসন নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক হতে পারেন, কিন্তু কাঁধের চোট নিয়ে ব্যাটিং করলেও তিনি তো ফিল্ডিংয়ে নামতেই পারেননি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে অধিনায়কত্ব করেছেন টিম সাউদি। বোলিং পরিবর্তন থেকে ফিল্ড সাজানো-সব তো তিনিই করেছেন। জয়ের কৃতিত্বটা তাই তাঁরই পাওনা। কেন উইলিয়ামসন অবশ্য মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো। পারতপক্ষে সাংবাদিকদের মুখ দেখতে চান না। খুবই স্বাভাবিক যে এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তিনি দূরে সরে থাকবেন। মাঠে কথা বলেছেন। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে পাঠিয়ে দিলেন টিম সাউদিকে। কেন যেন মনে হচ্ছে, সুযোগ থাকলে মাহমুদউল্লাহও হয়তো তা-ই করতেন!
কেন উইলিয়ামসন নিজে চলে এলেও তাঁর জন্য সেটি আনন্দময় একটা অভিজ্ঞতাই হতো। এই সিরিজের আগেই প্রথমবারের মতো আইসিসি টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বরে উঠে যাওয়া, হ্যামিল্টনের পর ওয়েলিংটনেও জিতে এক টেস্ট বাকি থাকতেই নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা পঞ্চম টেস্ট সিরিজ জয়-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে এমন সুসময় কখনো আসেনি আগে। ভালো ভালো সব প্রশ্নই তাই করা হলো সাউদিকে।
কিন্তু মাহমুদউল্লাহকে তা করার সুযোগ কোথায়? ওয়ানডে সিরিজ শেষে বাংলাদেশ দল যখন ডানেডিন থেকে হ্যামিল্টনে আসছে, ডানেডিন বিমানবন্দরে যখন তাঁকে বলা হলো, ‘মাশরাফি তো চলে গেছে। টেস্টে আপনি অধিনায়ক, এটা তো এখন আপনার দল’, মাহমুদউল্লাহ মজা করে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি এখন বনের রাজা!’ পরের কথাটাও মজা করেই, ‘আমি সাকিবকে ফোন করব। ফোন করে বলব, “তোর দল, তুই এসে দায়িত্ব নে”।’ সেটি সত্যি সত্যি করতে পারলেই হয়তো খুশি হতেন। তাহলে যে তাঁকে এমন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না!
এই নিউজিল্যান্ড সফরে দুই টেস্টের আগে ৪টি টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন। সব কটিই ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসেবে। টেস্টের নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসান চোটের কারণে নেই বলে। হঠাৎ পাওয়া সেই দায়িত্ব তাঁর মতো করে ভালোই পালন করেছেন। জয়-পরাজয়ের হিসাবে হয়তো সেটির প্রতিফলন নেই। যে ৬টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার ৪ টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। এখানে দুটি। আর দেশে শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি করে। জিতেছে মাত্র একটিতে, ড্র হয়েছে অন্যটি। কিন্তু অধিনায়কত্ব যে তাঁর ব্যাটে কোনো বোঝা হয়ে চেপে বসেনি, সেটির প্রমাণ পারফরম্যান্সে। অধিনায়ক হিসেবে তাঁর ব্যাটিং গড় ৫৯.৪৪, ক্যারিয়ার গড় যেখানে মাত্র ৩৩.১৮। অধিনায়কের ভূমিকায় ২টি সেঞ্চুরি ও ২টি হাফ সেঞ্চুরিই প্রমাণ করে, নেতৃত্বটা তিনি সামনে থেকেই দিতে চান, সেটি পারেনও।
কিন্তু এই নিউজিল্যান্ড সফরে যেমন প্রস্তুতিহীন অবস্থায় চলে এসেছে বাংলাদেশ দল, তাতে মাহমুদউল্লাহকে মনে হচ্ছে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। নিজে ভালো খেলছেন, কিন্তু এটা তো আর একার খেলা নয়! মাহমুদউল্লাহকে কখনো কখনো তাই অসহায়ও লাগছে। অধিনায়ককে আশার কথা বলতে হয়, দলকেও শোনাতে হয়। সেটি বলতে গিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত লাগছে তাঁকে। কাল সংবাদ সম্মেলনে ‘আমাদের এই দল আরও ভালো করার সামর্থ্য রাখে’ বলার আগে নিজেই যেমন বলে নিলেন ‘শুনতে হয়তো হাস্যকর শোনাবে’।
তা তো একটু শোনাচ্ছেই। বাংলাদেশ দলের জন্য তিন টেস্টের সিরিজ ‘হ্যালির ধূমকেতু’র মতো, অনেক বছর পর পর একবার আসে। সেটি কি এখন উল্টো শাস্তি মনে হচ্ছে মাহমুদউল্লাহর?