সাকিব-মুশফিকদের কাশেম ভাই

>
আবুল কাশেম। বিকেএসপির বর্তমান, সাবেক সব ছাত্রের প্রিয় ‘কাশেম ভাই’। ছবি: খালেদ সরকার
আবুল কাশেম। বিকেএসপির বর্তমান, সাবেক সব ছাত্রের প্রিয় ‘কাশেম ভাই’। ছবি: খালেদ সরকার
আবুল কাশেম। বিকেএসপির ছাত্রদের ‘কাশেম ভাই’। অসাধারণ স্মরণশক্তি, সস্নেহ নজরদারি ও ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে নিজেকে বসিয়েছেন পাঁচটি ছাত্র হোস্টেলের একক অভিভাবকের আসনে। যাঁর চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাহস নেই কোনো ছাত্রের। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম; ফুটবলার হাসান আল মামুন, মাসুদ রানা, মামুনুল ইসলাম; শুটার আসিফ হোসেনদেরও ছাত্রাবস্থায় ‘দাদাগিরি’ থেমে যেত কাশেম ভাইয়ের সামনে। তাঁরা যেন ছিলেন আবুল কাশেমের ‘বাঁ’ হাতের খেল। লিখেছেন রাশেদুল ইসলাম

ঝড় কিংবা বৃষ্টি, তপ্ত রোদ অথবা কুয়াশাঢাকা শীতের সকাল—ছাত্রাবাসের কলাপসিবল গেটের সদর দরজা খুলেই শুরু হয় তাঁর দিন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে এই নিয়ম—প্রতিদিন। কলাপসিবল গেট পেরিয়ে চার দেয়ালের মধ্যে কত ছাত্রের রঙিন স্বপ্ন পূরণ হতে দেখেছেন। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া প্রিয় ছাত্রদের কেঁদে ভাসানো মুখ দেখে অজান্তে ভিজিয়েছেন নিজের চোখের কোনাও। সাফল্য-ব্যর্থতার চাদর গায়ে মুড়িয়ে কত ছাত্র বিদায় নিল, বিকেএসপির হ্রদে পড়ল কত সহস্র সূর্যাস্তের আভা। সবকিছুরই সাক্ষী মো. আবুল কাশেম।

১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) গোড়াপত্তন থেকেই আছেন আবুল কাশেম। মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়ে তাঁর চোখের সামনে কাদামাটি থেকে তারকা হয়ে উঠে প্রতিষ্ঠানটির আকাশে জ্বলজ্বল করছে একঝাঁক তারকা। সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করা সাকিব আল হাসান। মাগুরা থেকে আসা সাকিব যদি হন পৃথিবী থেকে দেখা শুক্র গ্রহের মতো সবচেয়ে উজ্জ্বল—ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মুশফিকুর রহিম, নাসির হোসেন; ফুটবলার হাসান আল মামুন, মাসুদ রানা, মামুনুল ইসলাম; হকির মামুনুর রশিদ, রাসেল মাহমুদ জিমি; শুটার আসিফ হোসেন, আবদুল্লাহ হেল বাকিরাও নেই খুব একটা পিছিয়ে। তারকাদের মধ্যে অমিলের অভাব নেই, কিন্তু মিল আছে একবিন্দুতে। ছাত্র থাকা অবস্থায় সবার ‘দাদাগিরি’ থেমে যেত কাশেম ভাইয়ের সামনে। তাঁরা ছিলেন কাশেমের ‘বাঁ’ হাতের খেল। ফুটবল বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে কাশেম ভাইয়ের সেই শাসন আর ভালোবাসা পাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে এই প্রতিবেদকেরও।

 আতঙ্কের ‘রাডার’ কিংবা আস্থার ‘উইকিপিডিয়া’

কেউ ডাইনিংয়ে না এসে রুমে ঘুমাচ্ছে বা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে হোস্টেলের কোনার রুমে বসে দিচ্ছে আড্ডা—আবুল কাশেমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অনিয়ম করা ছাত্র কোন বিভাগে খেলে, কী নাম, ক্যাডেট নম্বর কত? কাশেমের মাধ্যমে সব পৌঁছে যাবে ছাত্রের কোচ ও শ্রেণিশিক্ষকের কাছে। হোস্টেলের সবচেয়ে সুবোধ ছেলেটার বৃত্তান্ত জানতে হলেও ভরসা তিনি। মোদ্দা কথা, ছাত্রদের ভালো-মন্দ যেকোনো তথ্যই সংরক্ষিত থাকে তাঁর মাথায়। খাতা–কলমে আবুল কাশেমের পরিচয় হাউস বেয়ারা হলেও ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে তাঁর পরিচিতি রাডার ও উইকিপিডিয়া। আর দুই পক্ষের কাছেই ‘কম্পিউটার’।

ছাত্রাবাসে ঢুকে দায়িত্বরত কোনো শিক্ষকের জানা প্রয়োজন পড়ল উপস্থিত ছাত্রসংখ্যা কত? খাতা–কলম দেখতে হয় না, ডানে–বাঁয়ে তাকালেই পাওয়া যাবে মুশকিল আসানকে। কতজন ছাত্র হোস্টেলে আছে, কতজন ছুটিতে, খেলতে গিয়েছে কতজন, কতজন মেডিকেলে ভর্তি? ক্যাডেট নম্বরসহ সব হিসাবই থাকে তাঁর মাথায়। পাঁচটি ছাত্র হোস্টেলের (বিকেএসপিতে বলা হয় হাউস) পুঙ্খানুপুঙ্খ, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর তথ্য মিলবে জীবন্ত উইকিপিডিয়ার কাছে। ভুল বললাম, ‘বিকেএসপির কম্পিউটারে’।

বিকেএসপির ছাত্রাবাসের নিয়ম স্বাভাবিকভাবেই বেশ কড়াকড়ি নিয়মে আবদ্ধ। যেগুলো প্রয়োগ করতে আবুল কাশেমের জুড়ি নেই। ছুটি শেষে বিলম্বে প্রত্যাবর্তনের জন্য দিনপ্রতি ১৫০ টাকা হারে জরিমানা গুনতে হবে (বিলম্ব বা অনুপস্থিতির যৌক্তিক কারণ প্রমাণ করলে জরিমানা মওকুফ/শিথিলযোগ্য), ছুটিতে যাওয়া ও ফেরার সময় প্রশিক্ষণার্থীকে অবশ্যই কলেজ ও হোস্টেলে রক্ষিত রেজিস্ট্রারে স্বাক্ষর করতে হবে, ক্যাম্পে অবস্থানকারী কোনো প্রশিক্ষণার্থী কিংবা জনসাধারণের হাউসে প্রবেশ নিষেধ। এসব নিয়মের ব্যত্যয় হলেই রক্ষা নেই।

 একজন ‘কাশেম ভাই’

আবুল কাশেমের কী এক জাদুকরি শক্তি। চাকরিজীবনের গোধূলিবেলায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষকে মাঝেমধ্যে মেমোরি টেস্ট দিতে হয় বর্তমান সময়ের ‘দুষ্টু’ ছাত্রদের কাছে। পুরোনো কাগজের ভ্যাপসা গন্ধ ছড়ানো ছোট্ট অফিসকক্ষে বসে ৫৫ বছর বয়সী আবুল কাশেম যখন হিসাব মেলাতে ব্যস্ত, তখন ছাত্ররা গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কাশেম ভাই, আমার ক্যাডেট নম্বর কত?’ ক্ষণিকের জন্য চোখ উঠিয়ে আবার হিসাব কষতে কষতেই বলে দেন ক্যাডেট নম্বর ও খেলার নাম। অথচ চাকরিজীবনে ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু করে একে একে বিদায় হয়েছে ২৬টি ব্যাচ।

বিকেএসপির বর্ণিল ইতিহাসে অনেক হাউস বেয়ারাই এসেছেন। বিভিন্ন অনিয়ম, অসৎ উপায় অবলম্বনের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে ছাড়তে হয়েছে নান্দনিক চত্বর। তবে আজ অবধি কোনো অনিয়মের ধারেকাছে ঘেঁষার অভিযোগ নেই কাশেমের নামে। নিজের দায়িত্বে সৎ, কর্মঠ, আপসহীন থাকায় মিলেছে স্বীকৃতিও। একমাত্র হাউস বেয়ারা, যিনি কলেজ প্রিন্সিপাল কর্তৃক পুরস্কার হিসেবে হোস্টেলে থাকার জন্য ঘর পেয়েছেন। বিকেএসপির ৪ নম্বর হাউসের নিচতলার পূর্ব পাশে আবুল কাশেমের ঘর।

১৯৮৬ সালে ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির মোট ৪০ জন ছাত্র নিয়ে শুরু বিকেএসপির। এখন খেলার সংখ্যা বেড়ে ১৭। কিন্তু শুরু সেই কাশেম আজও অমলিন। ছাত্র থাকা অবস্থায় বিকেএসপির ছেলেদের কাছে ‘যম’ হলেও পরবর্তী অধ্যায়ে ভালোবাসার এক নাম। আর কাশেমের কাছে ছাত্রদের ভালোবাসাই একমাত্র পুঁজি।

প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য এবং টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়। কিন্তু বিকেএসপিতে পা রাখলেই ‘এমপি’ সাহেব হয়ে পড়েন পুরোদস্তুর ছোট্ট দুর্জয়। হোস্টেলের ইটের গায়ে শোঁকেন কৈশোরের ঘ্রাণ। যে দিনগুলোর সাক্ষী কাশেম, ‘গত বছর দুর্জয় ভাই আসছিল। হোস্টেলের গেটেই আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়ায়ে ধরে কত গল্প। এমপি হয়েও আমার মতো হোস্টেল বেয়ারাকে মনে রাখছে।’

বিভিন্ন সময়ে খেলা ও ক্যাম্পের সুবাদে ক্রিকেটার ও ফুটবলারদের পা-ই বেশি পড়ে বিকেএসপিতে। মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, মামুনুল ইসলামরা যত বড় তারকাই হোন না কেন, এখনো যেন কাশেমের বাধ্যগত। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বা হোস্টেলে এলে কাশেম ভাইয়ের সঙ্গে তাঁদের দেখা না করলে যেন চলেই না। তাই তো মুশফিক, সাকিবরা গাড়ি থামিয়ে কাশেমের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে তাঁর পরিবারের খোঁজখবর নিয়েই ছাড়েন বিকেএসপি। ছোট্ট সাকিব, মুশফিকেরা আজ বড় তারকা হয়েও মনে রেখেছেন, গল্পগুলো বলতে বলতে কাশেমের চোখের কোনায় জমে ওঠে জল।

 শোকের কষ্ট, গর্বের উপলক্ষ

একটি মৃত্যু তাঁকে অনেক কষ্ট দেয়, গর্বের উপলক্ষও। ২০১৭ সালে সিলেটে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন র​্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের গোয়েন্দাপ্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। অনেকের হয়তো জানা নেই, তিনি ছিলেন বিকেএসপির ক্রিকেট বিভাগের ছাত্র। কাশেম বলেন, ‘ছাত্র থাকা অবস্থায় আজাদ ভাইয়ের মতো ভালো ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। খুবই নম্র ভদ্র ছিল। রাত জেগে পড়াশোনা করত। মানুষটা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে।’

গুমোট পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসার জন্য জিজ্ঞেস করি, আপনাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালিয়েছে কে? মুহূর্তের মধ্যে কাশেমের চোখেমুখে রোমাঞ্চের ঝিলিক, ‘আর বইলেন না, নাসির (ক্রিকেটার)। খুব দুষ্টু ছিল। ওর জ্বালায় আমি অতিষ্ঠ থাকতাম। কিন্তু মনটা খুব ভালো। দুপুরের খাবারে দেওয়া আপেল বা কমলা না খেয়ে আমার জন্য নিয়ে আসত। বুঝেনই তো আমাকে “ঘুষ” দিতে চাইত। হা... হা...।’

কাশেমের মতো জীবন্ত ইতিহাস পেয়ে অলরাউন্ডার সাকিবের কথা না শুনলে কি হয়! ‘সাকিব ভাই তো খুব ঠান্ডা মানুষ ছিলেন। নিয়মিত ক্লাস করতেন, কখনো প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে হাউসে ঘুমাতেন না। কয়েক বছর আগে একবার এক নম্বর মাঠে
ফিল্ডিং করতিছেন। আমাকে রাস্তা দিয়ে যাওয়া দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছেন।’

 বাড়ি তাঁর টাঙ্গাইল

যাঁর স্মৃতিতে এত তারকার জীবনের গল্প, তাঁর জীবন সমাজের পোড় খাওয়া আর দশটা মানুষের মতোই। দুই সপ্তাহ পরপর টাঙ্গাইলে পরিবারের কাছে ছুটে যান। কিন্তু একদিন থাকার পরেই ছাত্রদের জন্য কেঁদে ওঠে মন। বাবা-মা ছেড়ে হোস্টেলে ওঠা ছাত্ররা যে তাঁর সন্তানের মতোই!

খাতা–কলমের হিসাবে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট বিকেএসপি থেকে অবসরে যাওয়ার কথা আবুল কাশেমের। তাঁর বিদায়ে নিশ্চয়ই ডুকরে কেঁদে উঠবে খেলোয়াড় তৈরির কারখানা। যুগ যুগ ধরে পালা করে আসা নবীনেরা বড় ভাইদের মুখ থেকে ধারাবাহিকভাবে শুনে যাবে ‘এক যে ছিল কাশেম ভাই’। আর পুরোনোরা প্রিয় হোস্টেলে ফিরে নিজের কৈশোরের ঘ্রাণের সঙ্গে দেখতে পাবেন কাশেম ভাই লেগে আছেন বিকেএসপির দেয়ালে দেয়ালে।