ক্রাইস্টচার্চে আড়াল রঙ্গশালার নাকানিচুবানি

নেপালের খেলোয়াড়কে ঠেকাতে গিয়ে গলদঘর্ম বাংলাদেশের ডিফেন্ডার মারিয়া মান্দা। সংগৃহীত ছবি
নেপালের খেলোয়াড়কে ঠেকাতে গিয়ে গলদঘর্ম বাংলাদেশের ডিফেন্ডার মারিয়া মান্দা। সংগৃহীত ছবি
নারী সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বিরাট নগরের রঙ্গশালায় স্বাগতিক নেপালের কাছে ৩-০ গোলে উড়ে গিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা।


বাংলাদেশ ০-৩ নেপাল, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০ 

বাংলাদেশ ০-১ নেপাল, ১৯ নভেম্বর ২০১৪
বাংলাদেশ ০-৩ নেপাল, ১৬ মার্চ ২০১৯

নারী সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাসে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যকার লড়াইয়ের সারসংক্ষেপ। বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে না অবনতি, সেটা অবশ্য বোঝা না–ও যেতে পারে টাইমলাইন দেখে। ইদানীং বাংলাদেশের ফুটবলের সাফল্য–ব্যর্থতার সব গল্প নারী ফুটবল ঘিরেই। পুরুষ ফুটবলের ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি সরাতে নারী ফুটবল দলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। তবে কাল সে ঢালেই খুঁত ধরা পড়েছে।

বিরাট নগরের রঙ্গশালায় কাল স্বাগতিক নেপালের কাছে উড়ে যাওয়ার বিষয়টি দেশের মানুষকে তেমন স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর সেই সন্ত্রাসী হামলা। পুরো দেশের মানুষের চোখ ছিল ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে—কখন ঢাকার মাটি স্পর্শ করবে মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকদের বহনকারী উড়োজাহাজটি।

ক্রিকেট থেকে আবার ফেরা যাক ফুটবলে। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের তুরুপের তাস মেয়েদের ফুটবল। দেশের ফুটবলে সীমাহীন ব্যর্থতার মধ্যেও মেয়েদের বয়সভিত্তিক ফুটবলের সাফল্যকে দেয়ালে টাঙিয়ে নিজেদের অর্জনের বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচার করছে বাফুফে। মেয়ে ফুটবলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেদের গণ্ডির বাইরে গেলেই বের হয়ে আসে কঙ্কালসার দেহটা। বিশেষ করে জাতীয় দলের জার্সিতে বিদঘুটে হতশ্রী চেহারাটা ফুটে উঠছে বারবার।

নেপাল ৩-০ বাংলাদেশ, এতটা অসহায় আত্মসমর্পণ করবে বাংলাদেশের মেয়েরা, ঘুণাক্ষরে এমন ভাবনা হয়তো মাথায় আসেনি নেপালের কোনো সমর্থকেরও। শহীদ রঙ্গশালায় সাবিনাদের যেন ফুটবল খেলা শেখানোর চেষ্টা করেছেন সাবিত্রা ভান্ডারি, মঞ্জলি কুমারীরা। সঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন বাস্তবতাও। দক্ষিণ এশিয়ায় বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের মেয়েদের দুর্দান্ত প্রতাপ হলেও ছোটদের সেরা হওয়া মেয়েরা বড়দের ফুটবলে এখনো শিশুর মতোই।

এ ম্যাচের দিকেই তাকান না। বারবার মনে হয়েছে, সিনিয়র পর্যায়ে ভালো দলগুলোর বিপক্ষে খেলার মতো সামর্থ্য নেই মাসুরা পারভিন, শিউলি আজিমদের। প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ে বাংলার রক্ষণভাগ। একটু চাপেই বিচলিত হয়ে দেখাতে পারেন না বিল্ডআপ আক্রমণে ওঠার চেষ্টা। বলটা পা থেকে ছেড়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচলাম। কাকে দিচ্ছি, কোথায় দিচ্ছি; ভয়ে কুঁকড়ে অন্ধকারে ঢিল মারার মতো।

প্রথম গোলটা সেন্টারব্যাক মাসুরা পারভিন ও গোলরক্ষক রুপনা চাকমার যৌথ প্রযোজনায় আত্মঘাতী। মাসুরার হেড জড়িয়ে যায় বাংলাদেশের জালে। প্রথমত বলটি ক্লিয়ার করার ক্ষেত্রে তাঁকে বাধা দেয়নি প্রতিপক্ষ কোনো খেলোয়াড়। এ ছাড়া কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে পোস্ট ছেড়ে বের হয়ে আসেন গোলরক্ষক রুপনা। দুজনের ভুলের রসায়নেই এগিয়ে যায় নেপাল। দ্বিতীয় গোলটিতেও আছে রুপনার অবদান। বল নিয়ে গোল পোস্টের দিকে সাবিত্রা ভান্ডারি যাওয়ার সময় তাঁকে বাধা দিচ্ছিলেন সেন্টারব্যাক মাসুরা পারভিন। কিন্তু হুট করে অহেতুক পোস্ট ছেড়ে বের হয়ে এসে গোলমুখ খুলে দেন বাংলাদেশ গোলরক্ষক। নেপালের রোনালদো খ্যাত ভান্ডারি কি আর ভুল করার মানুষ।

তৃতীয় গোলটিতে ভান্ডারি প্রমাণ করেছেন কেন নিজ দেশে রোনালদোর আসনে বসানো হয়েছে তাঁকে। না গোল করে নয়, গোল করিয়ে। অবশ্য তাঁর কৃতিত্বে বাংলাদেশের রক্ষণভাগের অবদানও কম নয়। ডান প্রান্তে বক্সের সামনে রক্ষণভাগকে ঘোল খাইয়ে বাম প্রান্তে রক্ষণচেরা পাস দেন, আনমার্কড মঞ্জলি কুমারী কোনো রকম পায়ে লাগিয়ে জালে পাঠিয়ে দিলেন। নেপালি এই ফরোয়ার্ডকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। ৩-৪-৩ ফরমেশনে খেলা বাংলাদেশ শুরুর ২৫ মিনিটেই তিন গোল হজম করে হারিয়ে ফেলে ছন্দ! অথচ আগের সাফেই কী দুর্দান্ত খেলেছিলেন তাঁরা। প্রায় দুই বছরের বেশি সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে খেলে এই মেয়েদের অভিজ্ঞতা তো আরও বেড়েছে, কমেনি!

২০১৭ সালের শুরুতে বছরের শুরুতে কত স্বপ্নই না দেখিয়েছিল জাতীয় নারী ফুটবল দল। ছয় মাস আমেরিকায় অনুশীলন করে আসা আফগানদের জালে ৬ গোল দিয়ে বাংলাদেশের সাফ মিশন শুরু। আর শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে ড্র করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। সেমিফাইনালেও আবার প্রতিপক্ষ মালদ্বীপের গলায় গোলের মালা পরিয়ে দেওয়া। আর ফাইনালে ৩-১ গোলে হারলেও সেদিন কিছু ভুল না করলে জিততেও পারত বাংলাদেশ। প্রায় দুই বছরের বেশি সময়ের ব্যবধানে কৃষ্ণা রানী, স্বপ্নাদের তো আরও পরিণত হওয়ার কথা। কিন্তু কিসের কী, গোল হজমের পরিসংখ্যান দেখে মনে হচ্ছে তারা ফুটবলই ভুলে গিয়েছে!

২০১৭ সালে ২০ সদস্যের দলে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বের খেলোয়াড় ছিল ১৫ জন, ৮ জন খেলেছেন একাদশেই। সিনিয়র ফুটবলার বলতে ছিল সাবিনা খাতুন, সাবিনা আক্তার ও মাইনু মারমা। তাঁদের মধ্যে মাইনুকে প্রথমার্ধেই তুলে নেওয়া হয়েছিল। তাই সেবার সাফের শিরোপা হাতে তুলে না নিতে পারলেও সবার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ‘পরের টুর্নামেন্ট থেকে বাংলাদেশই ফেবারিট।’

বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ ভাবার কারণও ছিল যথেষ্ট। ১৬ বছরের মেয়েরাই অভিজ্ঞ কমলা দেবী, বালা দেবীদের ঠেকিয়ে দিচ্ছিলেন অনায়াসে। সময়ের পালাক্রমে এই মেয়েরা পরিণত হয়ে এলে তাঁরাই তো ছড়ি ঘোরাবের। কিন্তু পাশার দান তো উল্টে গেল। যেখানে অনূর্ধ্ব-১৬ খেলার পর ভারতসহ অন্যান্য প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে খেলেছেন মেয়েরা, সেখানে অনূর্ধ্ব-১৯ ও সিনিয়র পর্যায়ে খেলার পর পা থেকে ফুটবল সৌরভ হারানোর আভাস।

তাহলে কি বয়সে পরিণত হওয়ার সঙ্গে মেয়েদের পায়েও মরিচা ধরে গেল! দলটি জাতীয় দল হলেও বেশির ভাগ মেয়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এর মধ্যে আবার আটজন আছে, যারা অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে সিনিয়র জাতীয় দল পর্যন্ত সব দলেই বর্তমানে খেলছে। ফলে একটা মেয়ে জাতীয় দলে খেলে আবার অনূর্ধ্ব-১৫–তে খেলছে। পারফরম্যান্স নেমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, সিনিয়র পর্যায়ে সে যে রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে তার ছিটেফোঁটাও নেই। ফলে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ছড়ি ঘুরিয়ে সিনিয়র পর্যায়ে গিয়ে পারছে না কুলিয়ে উঠতে।

নিজেরাও জানি সত্যিটা, নিজেরাও জানি কপটতা আর ছলনাটা ঠিক কোথায়। কিন্তু চোখ ঠেরে থাকি। কাকে ফাঁকি দিচ্ছি? নিজেদেরই নয় কি?