'হারকিউলিস' একদিন বাংলাদেশেও ছিলেন!

জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে অতীতচারী হয়ে পড়েছিলেন মনোহর আইচ। ছবি: এএফপি
জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে অতীতচারী হয়ে পড়েছিলেন মনোহর আইচ। ছবি: এএফপি

বেঁচে থাকলে অপরাজিত থাকতেন ১০৭ বছরে। কিন্তু জীবনের উইকেটে আউট হতেই হয়। মনোহর আইচও মহাকালের নিয়ম মেনে ফিরেছেন পরপারের ড্রেসিং রুমে। তিন বছর আগে সেখানে যখন ফিরলেন, তখন জানা গিয়েছিল কথাটা। মৃত্যুশয্যায় নাকি বহুবার সন্তানদের কাছে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমারে তোমরা একবার দেশে নিয়া গেলা না।’

ভিনদেশে থাকলে দেশে ফেরার সাধ থাকে সবারই। কলকাতা আইচের জন্য কি ভিনদেশ ছিল? বোধ হয় না। নইলে আলিপুর জেল থেকে বের হওয়ার পর ফিরতে পারতেন বাংলাদেশে। তা না করে জীবন কাটিয়ে দিলেন ওখানেই। ওখানেই গড়েছেন তাঁর শরীর নামের ‘মন্দির’। ওই ‘মন্দির’ গড়েই পেয়েছেন যত নাম-যশ-খ্যাতি। শুধু তার ভিত্তিটুকু গড়ে দিয়েছে বাংলাদেশের আলো-বাতাস-মাটি। কিন্তু জন্মভূমি তো! মনোহর তাই ফিরতে চাইতেন কুমিল্লার ধামতি গ্রামে। মরার আগে অন্তত একবার।

মনোহর আইচ। নব্বই টপকে যাওয়ার পর। ছবি: টুইটার
মনোহর আইচ। নব্বই টপকে যাওয়ার পর। ছবি: টুইটার

ফেরা হয়নি। কেন হয়নি, সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ আর নেই। তবে আজ এত দিন পর অন্য একটি প্রশ্ন তোলা যায়? সেটি দেশের বর্তমান ব্যায়ামবীরদের সঙ্গে মনোহরের নিবেদনের তুলনা করে। নিজেকে ঠিক কতটুকু নিংড়ে দিলে কতটুকু মেলে? মনোহরকে বাঙালি যে তাঁদের শরীরচর্চার ‘পথিকৃৎ’ আখ্যা দিয়েছে, সেটি তখনকার সময়ের জন্য, সে না হয় মানা গেল। একবার লোকটার বুকের ছাতি মেপে দেখুন, কী তাঁর শরীরচর্চার বসন্তে, কী শেষ প্রহরে! যৌবনে ‘বিপ্লবী’র ভূমিকায় চড় মেরেছিলেন এক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তার গালে। আর মরার আগে মানুষের কল্যাণে দান করে গেছেন নিজের শরীর, বুড়ো বয়সে যেখানে এই শরীর গড়তেন নিজের সেই ব্যায়াোগারও—সাধারণ মানুষ যেন তার রেখে যাওয়ার পরম্পরা ধরে রাখে।

কিন্তু মনোহরের মনোলোভা জীবনকে তাঁর বুকের ছাতির মতোই এটুকু ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে বডিবিল্ডিংয়ে নিজেদের ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ হিসেবে। একদিন বাঙালিরও এক ‘পকেট হারকিউলিস’ ছিল! ইউনিভার্স হওয়ার অনন্য উচ্চতায় বাঙালিকে তিনি একাই কিংবা সবার আগে পৌঁছে দেননি। মনোহরকে আলাদা করে মনে রাখার কারণ তাঁর জীবনপ্রণালি, প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিজের লক্ষ্য ছুঁয়ে আজীবন একই রকম থাকার জন্য।

যৌবনে এমন অনেক ট্রফিই ধরা দিয়েছিল তাঁর হাতে। ছবি: টুইটার
যৌবনে এমন অনেক ট্রফিই ধরা দিয়েছিল তাঁর হাতে। ছবি: টুইটার

টাইটানিক যে বছর ডুবল, সে বছর অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লায় এই মহিরুহের জন্ম। গ্রামে আর দশটা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোনো’র সংসারের মতো মনোহরের পরিবারেও আর্থিক টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু খেলাধুলা তাঁকে ও নিয়ে পড়ে থাকতে দেয়নি। কুস্তির মতো শরীরচর্চা-নির্ভর খেলাধুলা তাঁকে টানত বেশি। কৈশোর থেকেই নানা রকম কসরত দেখাতেন গ্রামের বিভিন্ন মেলা-উৎসব-পার্বণে। ১৫ বছর বয়সে তাঁর বাবা বিছানায় পড়লে মনোহরের কসরত দেখানোই ছিল সংসারে আয়ের উৎস। এই শরীরচর্চায় তাঁর উচ্চতাও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাত্র ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি। কিন্তু এই উচ্চতার মানুষটাই একদিন বাঙালিকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেবেন, তা জানত কে!

মনোহর নিজেও তখন জানতেন না। রাস্তাঘাটে কসরত দেখানোর মাধ্যমে একদিন তাঁর পরিচয় ঘটল উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম জাদুকর পিসি সরকারের সঙ্গে। সরকার বললেন, ‘আমার সঙ্গে যোগ দাও।’ মনোহর সায় দেওয়ার পর দুজন মিলে ‘ফিজিক অ্যান্ড ম্যাজিক’ নামের পথ-সার্কাসে যে জুটি গড়েছিলেন, তা তখনকার মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। প্রদর্শনীতে মনোহর লোহার দণ্ড বাঁকাতেন দাঁত ও কাঁধ দিয়ে। তরবারির মাথায় পেট দিয়ে ভর করে দেখিয়েছেন শরীরের ভারসাম্য। ১৫০০ পাতার বই আড়াআড়ি ছিঁড়েছেন এক টানে। আর ২০০ কেজির বেশি ওজন টেনেছেন অবলীলায়।

ভারতবর্ষের প্রবাদপ্রতিম ব্যায়ামবীর বিষ্ণু ঘোষের আখড়ায় মনোহরের শরীরচর্চার হাতেখড়ি। চল্লিশের দশকে মতান্তরে ১৯৪২ সালে তিনি যোগ দেন ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীতে। উচ্চতা অনেক কম হলেও শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে তাঁকে নেওয়া হয়। এখান থেকেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল। বাঙালি তখন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে সরগরম। এক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তার মুখে বাঙালির অপমান সহ্য করতে না পেরে কষে চড় মেরেছিলেন মনোহর।

কম উচ্চতাকে শরীরের পেশি দিয়ে জয় করেছিলেন মনোহর। ছবি: টুইটার
কম উচ্চতাকে শরীরের পেশি দিয়ে জয় করেছিলেন মনোহর। ছবি: টুইটার

তাঁর সবচেয়ে পুরোনো ছাত্র ক্ষিতীশের ভাষায় ঘটনার নেপথ্য কারণ, ‘ওই সময় একটা নিয়ম ছিল। রাতে ব্রিটিশ অফিসারদের ডিনারের পর যে খাবার বাঁচত, সেটা সকালে ভারতীয় সৈনিকদের দেওয়া হতো। আর বিষ্ণুদা (মনোহর) সেটা খেতে শুধু অস্বীকার করেছিলেন তা-ই নয়, প্রতিবাদও করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। যার ফলে সাত বছর সাজা হয় তাঁর।’

কিন্তু ছাড়া পেয়ে যান চার বছরেই। জেলবাসের সেই সময়ে মনোহর শরীরচর্চাকে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে নিয়ে নেন। ডন-বৈঠক আর কসরত করতে গিয়ে বাঁকিয়ে ফেলেছিলেন জেলের লোহার শিকও। কারা-কর্মকর্তারা মনোহরের শরীরচর্চার প্রতি আত্মনিবেদন দেখে তাঁকে আলাদা করে পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করতেন। লাহোর, পেশোয়ার হয়ে আলিপুর জেল থেকে মনোহর ছাড়া পেলেন স্বাধীন ভারতের মাটিতে।

শরীরচর্চার নেশা তখন মনোহরের মনে পুরোপুরি জেঁকে বসেছে। ৩৫ বছরের ওপাশে গিয়ে মন দিলেন পেশাদার শরীরচর্চায়। কিন্তু বাতাস খেয়ে তো আর শরীরচর্চা হয় না! ডাবের ঝুলি নিয়ে বসে গেলেন শিয়ালদহ স্টেশনে। এভাবে ১৯৫০ সালে জিতলেন ‘মিস্টার হারকিউলিস’ প্রতিযোগিতা। ব্যস, বাঙালি পেয়ে গেল তাদের হারকিউলিসকে। কিন্তু মনোহর যেতে চেয়েছিলেন আরও উঁচুতে, আর তাই পরের বছর অংশ নিলেন ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায়। পারলেন না মনতোষ রায়ের জন্য।

মিস্টার ইউনিভার্স জয়ের পর তুমুল খ্যাতি পেয়ে যান মনোহর। ছবি: টুইটার
মিস্টার ইউনিভার্স জয়ের পর তুমুল খ্যাতি পেয়ে যান মনোহর। ছবি: টুইটার

গ্রুপ থ্রি (শর্ট) অপেশাদার বিভাগে প্রথম এশিয়ান হিসেবে মিস্টার ইউনিভার্স খেতাব জেতেন এই বাংলাদেশেরই ছেলে মনতোষ। জন্ম বর্তমান মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়। মনতোষ বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেও তাঁর ছেলে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ মলয় রায়কে সম্ভবত মনে রেখেছেন সত্যজিৎয়ের সিনেমাপ্রেমীরা। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর সেই বডিবিল্ডার গুণময় বাগচী। সে যা-ই হোক, মনতোষের কাছে হেরে মনোহর সে বছর দ্বিতীয় হলেও হাল ছাড়েননি। থেকে যান লন্ডনেই। জুটিয়ে নেন ব্রিটিশ রেলওয়েতে কেরানির চাকরি। শরীরচর্চার খরচ তো মেটাতে হবে!

খেটেখুটে টানা একটি বছর নিজেকে প্রস্তুত করে ১৯৫২ সালে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার শরীরের বাইসেপ তখন ৪৬ সেমি, বুকের মাপ স্ফীত অবস্থায় ১২০ সেমি, হাতের প্রস্থ ৩৬ সেমি আর কবজি সাড়ে ১৬ সেমি আর কোমর মাত্র ২৩ ইঞ্চি। আদর্শ ‘ভি’ গঠনের এই শরীর নিয়ে মনোহরের মিস্টার ইউনিভার্স হওয়া সেবার আর কেউ ঠেকাতে পারেনি। পরের গল্পটা এই উপমহাদেশের মোটামুটি বাকি সব কিংবদন্তির মতোই। ঈর্ষণীয় খ্যাতির গগনে বিরাজ করলেন মনোহর। আর শেষ বয়সে ভুগেছেন আর্থিক টানাটানিতে। তাঁর সন্তানেরা সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছেন বাবাকে ভালো রাখার। সেটি পুরোপুরি হয়ে না উঠলেও মনোহরের কোনো আক্ষেপ ছিল না। পরিবারের ভাষায়, ‘জীবন যেখানে যেমন’—এটাই ছিল মনোহরের দর্শন।

হেলথ অ্যান্ড স্ট্রেংথ ম্যাগাজিনের কভারে মনোহর। ছবি: টুইটার
হেলথ অ্যান্ড স্ট্রেংথ ম্যাগাজিনের কভারে মনোহর। ছবি: টুইটার

নিজের শরীরচর্চার আখড়া থেকে মিস্টার ইউনিভার্স আর মিস্টার ইন্ডিয়ার জন্ম দিয়েছেন মনোহর। উপমহাদেশে পাওয়ার বিল্ডিংয়ের শুরুটা তাঁর হাতে। ৮৯ বছরে পা রেখেও দেখিয়েছেন শরীরচর্চার প্রদর্শনী। ১০৪ বছরের দীর্ঘ জীবনে ছোটবেলায় ভুগেছেন কালাজ্বর আর এশিয়ান কলেরার মতো মহামারিতে। দুবার হার্ট অ্যাটাকও হয়েছিল। এর মধ্যে শুধু শেষবার তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। মনোহরের এই অনমনীয় শরীরের পেছনে ভিত গড়েছে সেই উক্তিটা ‘পান্তা ভাতের জল, তিন পুরুষের বল।’

এখনকার শরীরচর্চায় উচ্চমাত্রার প্রোটিন পিল আর ডাম্বেল-নির্ভর জিমনেসিয়ামের পাশে মনোহরের খাদ্যতালিকা রাখুন—পান্তা ভাত, ডাল, শাকসবজি আর মাছের মাথা। মাছের মাথায় নাকি গ্রোথ হরমোন থাকে, মনোহর বলতেন। আধুনিক জিমে গিয়ে কষে ওয়েটলিফটিং একদম পছন্দ করতেন না। সাবেকি কায়দায় ডন-বৈঠকে ভরসা রেখেই বাঙালির মাথায় বিশ্বসেরার মুকুট পরিয়েছিলেন মনোহর। বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করার দিন (মিস্টার ইউনিভার্স জয়) আর তাঁর জন্মও একই দিনে। আজ এই দিনে!

অথচ এই মানুষটা মরার আগে একবার জন্মভূমিতে ফিরতে পারলেন না।