এমন সম্মান মেসি আগেও পেয়েছিলেন

মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, দেল পিয়েরো, রোনালদো, ইনিয়েস্তা, টট্টি...প্রতিপক্ষের সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন এমন অনেকেই। ছবি: মার্কা
মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, দেল পিয়েরো, রোনালদো, ইনিয়েস্তা, টট্টি...প্রতিপক্ষের সম্মান আদায় করে নিয়েছিলেন এমন অনেকেই। ছবি: মার্কা

‘সত্যি বলতে, গোলের জন্য কখনো প্রতিপক্ষের সমর্থকেরা আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছে, এমনটা আমার মনে পড়ে না।’ গত রোববার রিয়াল বেতিসের মাঠে মুগ্ধতা ছড়িয়ে প্রতিপক্ষ সমর্থকদেরও অভ্যর্থনা আদায় করে নেওয়ার পর বলেছিলেন সলজ্জ লিওনেল মেসি। বার্সেলোনার আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের মনে না থাকলেও, স্প্যানিশ দৈনিক মার্কা খুঁজে বের করেছে, মেসির এমন অভিজ্ঞতা আগেও একবার হয়েছে। খুঁজেছে এমন অভিজ্ঞতা আর কার হয়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে, তাঁদের নামও। মার্কার অনুসন্ধান বলেই ঘটনাগুলো সব স্প্যানিশ দলকে ঘিরেই।

ডিয়েগো ম্যারাডোনা
রিয়াল মাদ্রিদ ২: ২ বার্সেলোনা
(১৯৮২-৮৩ কোপা দে লা লিগা)
কোপা দে লা লিগার (সেই বছর শুরু হয়ে চার বছর টিকেছিল টুর্নামেন্টটি) ফাইনালের প্রথম লেগের ঘটনা। এগিয়ে আসা গোলকিপারকে কাটিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ পোস্টের ইঞ্চি দুয়েক দূরত্বে ম্যারাডোনা, এমন সময় রিয়ালের এক ডিফেন্ডারের স্লাইডিং ট্যাকল। আলতো ড্রিবলিংয়ে তাঁকে এড়ালেন ম্যারাডোনা। গোলকিপার ততক্ষণে ফিরে এসে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। তাঁকে এড়িয়ে ম্যারাডোনার আলতো টোকায় বল জালে। বার্সেলোনা উচ্ছ্বসিত, সান্তিয়াগো বার্নাব্যু বিস্ময়াবিভূত! রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের একাংশ দাঁড়িয়ে হাতের সাদা রুমাল ওড়ালেন। আত্মসমর্পণের প্রতীক!

রোনালদো
ম্যান ইউনাইটেড ৪: ৩ রিয়াল মাদ্রিদ
(২০০২–০৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ)
কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় লেগ ছিল সেটি। ম্যাচটা রিয়াল মাদ্রিদ হেরে গেলেও প্রথম লেগ ৩-১ গোলে জেতায় সেমিতে যেতে সমস্যা হয়নি। হয়নি রোনালদোর হ্যাটট্রিকের কারণেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৪ গোল করেছে দ্বিতীয় লেগে, কিন্তু এক রোনালদোকেই যে সামলাতে পারেনি। দারুণ হ্যাটট্রিক করেছেন, বক্সের অনেক বাইরে থেকে বাঁকানো শটে তৃতীয়টি তো দুর্দান্ত। হারের হতাশা সয়েও ইউনাইটেড সমর্থকেরা যে পারফরম্যান্সকে সম্মান জানাতে ভোলেননি।

রোনালদিনহো
রিয়াল মাদ্রিদ ০: ৩ বার্সেলোনা
(২০০৬ লা লিগা)
তাঁর পায়ে ফুটবল কেন হাসে, ম্যাচজুড়ে চোখধাঁধানো সব ঝলকে বারবার সেটি বুঝিয়েছেন। আর দলের শেষ দুটি গোল যখন করলেন রোনালদিনহো, রিয়াল মাদ্রিদের ডিফেন্ডার-গোলকিপার অসহায়, আর সান্তিয়াগো বার্নাব্যু মুগ্ধ। মাঝমাঠ থেকে বল টেনে এনে রামোসকে একঝটকায় ছিটকে ফেললেন, বক্সে ঢুকে হেলগুয়েরাকে দর্শক বানিয়ে দিলেন শরীরের এক নাচনে, তাঁর শট বুঝতে পারেননি ক্যাসিয়াসও। দ্বিতীয়টিও কম মুগ্ধ করার মতো নয়। উঠে দাঁড়িয়ে করতালিতে যে পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি দিয়েছে পুরো বার্নাব্যু।

আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো
রিয়াল মাদ্রিদ ০: ২ জুভেন্টাস
(২০০৮–০৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ)
বয়স তখন তাঁর ৩৪। কিন্তু সেই ম্যাচটাতে দেল পিয়েরো এমনভাবে খেলেছিলেন যে তাঁকে কেউ ২৫ বছরের যুবক ভাবলেও হয়তো ভুল হতো না। বার্নাব্যুতে গ্রুপ পর্বের ম্যাচটা ২-১ গোলে জিতেছে জুভেন্টাস, দুটি গোলই তাঁর। প্রথমটি বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের মাটি কামড়ে বাঁকানো শটে, দ্বিতীয়টি দুর্দান্ত ফ্রি কিকে। পুরস্কার? ম্যাচ জয়ের পাশাপাশি রিয়াল সমর্থকদের কুর্নিশ।

লিওনেল মেসি
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ১-৩ বার্সেলোনা
(২০০৮–০৯ কোপা ডেল রে)
সেই বার্সেলোনা ছিল পেপ গার্দিওলার প্রথম মৌসুমের বার্সা। সেই অ্যাটলেটিকো ডিয়েগো সিমিওনের অ্যাটলেটিকো ছিল না, তবে সে দলেও ফোরলান-আগুয়েরো-সিমাওরা ছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগেই মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সই থামিয়ে দেয় অ্যাটলেটিকোকে। হ্যাটট্রিক করেছিলেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। এর মধ্যে শরীরের নাচনে গোলকিপারকে এড়িয়ে তৃতীয় গোলটি তো ছিল দারুণ। সে সময়ের অ্যাটলেটিকোর মাঠে ভিসেন্তে কালদেরনের দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে মেসিকে জানায় সম্মান।

আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা
এসপানিওল ১: ৫ বার্সেলোনা (২০১০–১১ লা লিগা)
ম্যাচে কোনো গোল করেননি, গোলে সহায়তাও নয়। তবু আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা প্রতিপক্ষ দর্শকদের কুর্নিশ পেয়েছিলেন, সেটিও নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসপানিওলের মাঠে। কারণটা অন্য। সেই বছরই স্পেনকে বিশ্বকাপ জেতানো গোলটি করা ইনিয়েস্তা প্রায় সব মাঠেই দারুণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন। কিন্তু স্পেনের মাঠে সেটি বেশি হওয়ার কারণ, ২০১০ বিশ্বকাপ জেতানো গোলটি বার্সা মিডফিল্ডার উৎসর্গ করেছিলেন পরলোকে চলে যাওয়া দানি হার্কেকে, তাঁর জার্সির ভেতরের গেঞ্জিতেও তা লেখা ছিল। আর মৃত্যুর আগমুহূর্তেও দানি হার্কের হাতে ছিল এসপানিওলের অধিনায়কের বাহুবন্ধনী।

জাভি
অ্যাথলেটিক বিলবাও ২: ৫ বার্সেলোনা
(২০১৫-১৫ লা লিগা)
অনেকটা ইনিয়েস্তার মতোই গল্প। যতটা না পারফরম্যান্সের কারণে, তার চেয়েও বেশি আবেগ থেকেই প্রতিপক্ষের মাঠে জাভির সম্মানটা পাওয়া। বার্সেলোনায় সেটি যে তাঁর শেষ মৌসুম হতে যাচ্ছে, তা তত দিনে ঘোষিত। ম্যাচে হেরে গেলেও তাই এত বছর ধরে স্প্যানিশ ফুটবলের প্রতিনিধিত্ব করে যাওয়া, স্পেনের বিশ্ব ফুটবলে বড় শক্তি হওয়ার পথে অন্যতম বড় কারিগরকে সম্মান জানাতে অকুণ্ঠই ছিলেন বিলবাও সমর্থকেরা।

ফ্রান্সেসকো টট্টি
রিয়াল মাদ্রিদ ২: ০ রোমা
(চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০১৬-১৭)
জাভির মতোই বিদায়বেলায় কিংবদন্তিকে সম্মান জানানোর ঘটনা এটিও। ম্যাচে রোমা হেরেছে, গোলও করতে পারেনি। তত দিনে ৪১-এ পা দেওয়া টট্টি সেই মৌসুম শেষেই বুটজোড়া তুলে রেখেছেন। শেষ ষোলোর ম্যাচটিতে তাই ‘রোমান কিং’য়ের জ্বলজ্বলে ক্যারিয়ারের প্রতি সম্মান জানাতেই উঠে দাঁড়ায় পুরো বার্নাব্যু।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
জুভেন্টাস ০: ৩ রিয়াল মাদ্রিদ
(চ্যাম্পিয়নস লিগ ২০১৭–১৮)
বেতিসের মাঠে মেসির হ্যাটট্রিক পূর্ণ করা গোল আর গত মৌসুমে জুভেন্টাসের মাঠে রোনালদোর ওই ওভারহেড কিক—চাইলে দুজনের ফুটবলের ধরনের পার্থক্য বোঝাতে এই দুটি গোলকেই ব্যবহার করা যায়। দুটিই অসহ্য সুন্দর গোল, কিন্তু দুটিতে ভিন্নতা অনেক। মেসির নিখুঁত চিপ আর কক্ষপথে এগোতে থাকা গ্রহের মতো বলের পোস্টে ঢোকা যদি সময় থেমে যাওয়ার অনুভূতি দিয়ে থাকে, মার্সেলোর ক্রসে রোনালদোর ওই চোখধাঁধানো ওভারহেড কিক চোখ তুলে দিয়েছে কপালে। মুহূর্তের ঝলকে অবিশ্বাস্য কিছু দেখে ফেলার অনুভূতি। যে অনুভূতি ছেয়ে গিয়েছিল পুরো জুভেন্টাস স্টেডিয়ামেই।