পেছনে হাঁটার গল্প: শিলিগুড়ি থেকে বিরাটনগর

শিলিগুড়ি সাফে ছিল বাংলাদেশের মেয়েদের দাপট। ফাইল ছবি
শিলিগুড়ি সাফে ছিল বাংলাদেশের মেয়েদের দাপট। ফাইল ছবি
>

২০১৬-১৭ সালে ভারতের শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত মেয়েদের সাফে দুর্দান্ত খেলে রানার্সআপ হয়েছিল বাংলাদেশ। প্রায় সেই দলটাই এবার নেপালের বিরাটনগরে সাফের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিল। এবার স্পষ্টত ফুটে উঠেছে মেয়েদের ব্যক্তিগত ও দলীয় পারফরম্যান্সের অবনতি

২০১৬-১৭ সালে শিলিগুড়িতে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত খেলেছিল বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বে ভারতের সঙ্গে গোলশূন্য ড্রয়ের পর ফাইনালে লড়াই করে হেরেছিল ৩-১ গোলে। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও সাবিনা-স্বপ্নারা সেবার সবার মন জয় করে ফিরেছিলেন। আশান্বিত করেছিলেন দেশের ফুটবলপ্রেমীদের। মনে করা হয়েছিল, শিলিগুড়িতে না পারলেও পরের টুর্নামেন্টে নিশ্চয়ই মেয়েরা ছিনিয়ে আনবে সাফের শিরোপা। ভারত, নেপাল, আফগানিস্তানের কোচরা একবাক্য বলেছিলেন, চ্যাম্পিয়ন হয়তো হতে পারেনি, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের ফুটবলের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশই।

ফাইনালের হার পাশে রাখলেও পুরো টুর্নামেন্টে ছিল বাংলাদেশের মেয়েদের দাপট। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে ছিন্নভিন্ন করে সাবিনা হয়ে উঠেছিলেন টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড। পুরো টুর্নামেন্টেই দেশের নারী ফুটবলের এই তারকা আতঙ্কে রেখেছিলেন প্রতিপক্ষের। ডান প্রান্তে কৃষ্ণা রানী সরকারের ওভারস্টেপ দৃষ্টি কেড়েছিল। স্বপ্নার এরিয়াল প্লেসিংয়ের গোল অবাক করেছিল দর্শকদের। মোটকথা দৃষ্টিনন্দন ফুটবল কাকে বলে, সেটি দেখিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা।
বাংলাদেশের সে দলটির গড় বয়স ছিল ১৮-এর নিচে। ২০ সদস্যের দলে ১৫ জনই ছিল এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ প্রতিযোগিতার চূড়ান্তপর্বে কোয়ালিফাই করা দলের সদস্য। এই দলটিই ফাইনালে নামার আগে তিন ম্যাচে কোনো গোল খায়নি। প্রতিপক্ষের জালে দিয়েছে ১২ গোল। সাবিনাকে বাদ দিলে ফরোয়ার্ড লাইনের বাকি দুজন—কৃষ্ণা আর স্বপ্না দুজনই ছিলেন অনূর্ধ্ব-১৬ দলের। দলটিকে নিয়ে আশা, স্বপ্ন দেখতে শুরু করা সেখান থেকেই।

ভারতের শিলিগুড়ি থেকে নেপালের বিরাটনগর। গত তিন বছরে পুরো পরিস্থিতিই গেছে পাল্টে। নাহ, সাবিনা-কৃষ্ণাদের দলটি আরও দুর্দান্ত হয়ে ওঠেনি। উল্টো অবনতির চিত্রটা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে। যে ভারতের সঙ্গে আগেরবার দুই ম্যাচে চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিল মেয়েরা, সেই দলটির বিপক্ষেই এবার নেপালে গিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ।

ইদানীং বাংলাদেশের ফুটবলের সাফল্য-ব্যর্থতার সব গল্প নারী ফুটবল ঘিরেই। পুরুষ ফুটবলের ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি সরাতে নারী ফুটবল দলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। মেয়ে ফুটবলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেদের গণ্ডির বাইরে গেলেই বের হয়ে আসে কঙ্কালসার দেহটা। বিশেষ করে জাতীয় দলের জার্সিতে মেয়েদের ফুটবলের দুর্বলতা ফুটে উঠছে বারবার।

বিরাটনগরে ভারতের বিপক্ষে অসহায় বাংলাদেশের মেয়েরা।
বিরাটনগরে ভারতের বিপক্ষে অসহায় বাংলাদেশের মেয়েরা।

সাফে নেপাল ও ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দেখে বারবার মনে হয়েছে, সিনিয়র পর্যায়ে ভালো দলগুলোর বিপক্ষে খেলার মতো সামর্থ্য নেই মাসুরা পারভিন, শিউলি আজিমদের। প্রতিপক্ষের প্রেসিংয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ে রক্ষণভাগ। একটু চাপেই বিচলিত হয়ে যান তারা। ব্যর্থতা আড়াল করতে দলের কোচিং স্টাফ মেয়েদের অনভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে ফেনা তুলেছেন মুখে। কিন্তু প্রশ্নটা এসেই যায়, যারা ১৬ বছর বয়সে দুর্দান্ত খেলেছে, দুই বছরেরও বেশি সময়ে তাদের খেলায় উন্নতির বদলে অবনতি হলো কেন? কৃষ্ণা, স্বপ্নাদের তো আরও পরিণত হওয়ার কথা। কিন্তু কিসের কী, গোল হজমের পরিসংখ্যান দেখে মনে হচ্ছে, তারা ফুটবলই ভুলে গেছে!
অধিনায়ক সাবিনা খাতুনকে বাদ দিলে বেশির ভাগ মেয়ের বয়স ২০ বছরের নিচে, যাঁরা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে নিয়মিত খেলে থাকেন। এর মধ্যে আবার আটজন আছে, যারা অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে সিনিয়র জাতীয় দল পর্যন্ত সব দলেই বর্তমানে খেলছে। মূল সমস্যাটা এখানেই। একটা মেয়ে জাতীয় দলে খেলে আবার অনূর্ধ্ব-১৫-তে খেলছে। পারফরম্যান্স নেমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, সিনিয়র পর্যায়ে মেয়েটি যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হয়, বয়সভিত্তিক পর্যায়ে তার ছিটেফোঁটাও নেই। ফলে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ছড়ি ঘুরিয়ে সিনিয়র পর্যায়ে গিয়ে কুলিয়ে উঠতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে মেয়েরা।


সমস্যাটায় এখনই মনোযোগ দেওয়া দরকার। ফাঁকি দিলে নিজেদেরই ফাঁকিতে পড়ে যেতে হবে। তাই সময় থাকতেই সাবধান।